Image description
মিরপুরে পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে আগুন, ১৬ লাশ উদ্ধার, স্বজনদের আহাজারি

মর্মান্তিক। হৃদয়বিদারক। মিরপুরের রূপনগরে পোশাক কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত ১৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। মৃতদেহগুলো একটি পোশাক কারখানার ভবন থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে নিহতদের নাম-পরিচয় কেউ জানাতে পারেননি। মারাত্মকভাবে দগ্ধ ও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন আরও অনেকে। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। আগুন লাগা ভবনের সামনে ছবি হাতে নিয়ে নিখোঁজ স্বজনরা আর্তনাদ করছেন। তাদের ধারণা নিখোঁজরা- ওই ভবনের ভেতরেই আছেন। নিখোঁজ ও নিহতদের স্বজনদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠে রূপনগরের শিয়ালবাড়ি এলাকা। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৬ জনের মৃতদেহ উদ্ধারের তথ্য জানায় ফায়ার সার্ভিস। তখনো উদ্ধার অভিযান চলছিল। এ ছাড়া  কেমিক্যালের গুদামে তখনো আগুন জ্বলছিল। আগুনের সূত্রপাত নিয়েও সুনির্দিষ্ট তথ্য  মেলেনি। মরদেহগুলো উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। সেখানেই মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হবে। স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের জন্য ডিএনএ পরীক্ষার আলামত সংগ্রহ করা হবে। ঘটনাস্থল থেকে সিআইডি’র ক্রাইম সিন ও কেমিক্যাল ল্যাব এক্সপার্টরা আলামত সংগ্রহ করেছেন। 

গতকাল সকাল ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে শিয়ালবাড়ী এলাকার একটি পোশাক কারখানায় হঠাৎ বিস্ফোরণের কারণে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। পোশাক কারখানার ঠিক পাশেই ছিল একটি কেমিক্যাল গোডাউন। আগুন লাগার পরপরই কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পোশাক কারখানা ও গোডাউনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। ভবনটিতে রাসায়নিক থাকায় এবং প্রচণ্ড ধোঁয়ার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং ভেতরে প্রবেশ করে উদ্ধারকাজ চালাতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের বেশ বেগ পেতে হয়। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ভেতর থেকে ১৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। পোশাক কারখানার ২য় এবং ৩য় তলা থেকে মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। কেমিক্যাল গোডাউনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আরও সময় লাগবে। গোডাউনে ৬-৭ ধরনের কেমিক্যাল ছিল। আগুন ধরার সঙ্গে সঙ্গেই তা দ্রুত ছড়িয়েছে। তাই গার্মেন্টস অংশে থাকা কর্মীরা বাইরে বের হতে পারেননি এবং ছাদেও উঠতে পারেননি। তাই তাদের মৃত্যু হয়েছে। তিনি বলেন,  ঘটনার পর থেকে রাসায়নিকের গুদামের মালিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। যতটুকু জেনেছি, এটি আলম কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, সবাই বলে। পুলিশ এবং সেনাবাহিনী সবাই চেষ্টা করছে, (কারখানার) কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা পৌনে ১২টার দিকে হঠাৎ করে পোশাক কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পাশে থাকা রাসায়নিকের গোডাউনেও। খবর পেয়ে একে একে ঘটনাস্থলে পৌঁছে অগ্নিনির্বাপণে কাজ শুরু করে ফায়ার সার্ভিস। ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতার ভিড় সামলাতে দায়িত্ব পালন করেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এরপর তাদের সঙ্গে সহায়তায় যোগ দেন পাশে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্বেচ্ছাসেবক, পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবি। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, শিয়ালবাড়িতে তিনতলা ভবনে থাকা ‘আনোয়ার ফ্যাশন’ নামের একটি পোশাক কারখানা এবং তার পাশে থাকা টিনশেড ঘরে রাসায়নিকের গুদামে আগুন জ্বলছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। কিছুটা দূরে সেনাসদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, উৎসুক জনতা ও নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে আসা সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে শান্ত রাখার চেষ্টা করছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, তিনতলা পোশাক কারখানার নিচতলায় ‘ওয়াশ ইউনিট’ রয়েছে। সেখানে প্রথম আগুন লাগে। সেই আগুন পাশের রাসায়নিকের গুদামে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর আগুন তিনতলা পোশাক কারখানার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার পর কারখানা থেকে শ্রমিকরা নানাভাবে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেন। এর মধ্যেই অনেকে আটকা পড়েন। রাসায়নিকের গুদামে ব্লিচিং পাউডার, প্লাস্টিক, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ছিল। সেখান থেকে আসা ক্ষতিকর গ্যাসে এসব মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

স্বজনদের আর্তনাদ: চোখে জল আর হাতে ছবি নিয়ে পুড়ে যাওয়া পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামের আশপাশে স্বজনের খোঁজে ঘুরছেন অনেক মানুষ। তারা বলছেন, আগুন লাগার পর থেকে স্বজনদের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না তারা। মোবাইল ফোনেও সাড়া পাচ্ছেন না তারা। দুপুরে লাগা আগুন বিকালেও নিয়ন্ত্রণে না এলে এবং মৃত্যুর খবর আসতে থাকলে সেখানে ভিড় বাড়তে থাকে স্বজনদের। পুলিশের পক্ষ থেকে এখনও নিখোঁজ ব্যক্তিদের কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। নাসিমা আক্তার নামের এক নারী বলেন, ভাইয়ের ছেলে রবিন, এখানে জিএম ফ্যাশন নামে একটি কারখানায় কাটিং মাস্টার হিসেবে কাজ করেন। তার কর্মক্ষেত্র ছিল পুড়ে যাওয়া ভবনটির তিন তলায়। ভবনের পাঁচতলা থেকে শ্রমিকরা বের হতে পারলেও তিনতলা থেকে কেউ বের হতে পারেনি। এখন পুরো পরিবারের সদস্যরা রবিনের ছবি হাতে খুঁজতে বেরিয়েছেন। পোশাক কারখানায় কাজ করা খালিদ হাসান সাব্বিরকে খুঁজছেন তার মামাতো ভাই শাকিল আহমেদ। তিনি বলেন, সাব্বির আরমান গার্মেন্টসের স্টোর ইনচার্জ ছিলেন। সাব্বিরের ফোন এখনও বাজছে। তবে কেউ ধরছেন না। ঘটনাস্থলে বন্ধু সারোয়ারের ছবি হাতে ঘুরছেন আমানুল্লাহ। তিনি বলেন, তার বন্ধু সেখানকার একটি ‘ওয়াশিং ফ্যাক্টরিতে’ হেলপারের কাজ করতেন। অল্প কয়েকদিন হলো সারোয়ার এখানে কাজে যুক্ত হয়েছেন। আগুন লাগার পর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ১৪ বছর বয়সী ভাগনি মাহিরার খোঁজে ঘটনাস্থলে ছোটাছুটি করছিলেন মো. শফিকুল ইসলাম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার ভাগনি মাহিরা ওই কারখানার তিনতলায় কাজ করতো। আগুন লাগার পর থেকেই খুঁজছি। কোনো হাসপাতালেও পাইনি। ফায়ার সার্ভিস বলেছে- ধৈর্য ধরতে। একইভাবে নিখোঁজ নারগিস আক্তারের বড় বোন লাইজু বেগম জানান, সকাল পৌনে ৮টায় আমার বোন কাজে গিয়েছিল। সাড়ে ১১টার দিকে খবর পেলাম আগুন লেগেছে। তখনই জানতে পারি কেউ ভেতর থেকে বের হতে পারেনি। এখন পর্যন্ত কোনো খোঁজ নেই।

ঢাকা মেডিকেলে বাড়ছে ভিড়: নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজতে ঘটনাস্থলের পাশাপাশি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালের মর্গেও ভিড় করছেন স্বজনরা। সেখানেই ছবি হাতে আর্তনাদ, আহাজারি করছেন তারা। স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে ঢামেক মর্গের বাতাস। অনেকে জানেই না তাদের স্বজন জীবিত না মৃত। আর মৃত হলে মরদেহ ঘটনাস্থলের পুড়া ভবনে আছে নাকি মর্গে পাঠানো হয়েছে। মর্গে যেসব মরদেহ পাঠানো হয়েছে সেগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া সেটি সম্ভবও না। তবুও মরদেহ দেখে তারা স্বজনের মরদেহ আছে কি না খোঁজার চেষ্টা করছেন। 

আগুন লাগা কারখানা বিজিএমইএ’র সদস্য নয়: মিরপুরের রূপনগরের যে পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, তা বিজিএমইএ’র সদস্য নয় বলে তৈরি পোশাক উদ্যোক্তাদের এ সংগঠন জানিয়েছে। গতকাল বিজিএমইএ’র এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে যে কারখানায় আগুন লেগেছে, তা বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত কোনো পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি ওয়াশিং কারখানা। আরও বলা হয়, মিরপুরে শাহ্‌ আলী ওয়াশিং লিমিটেড ও রাসায়নিক গোডাউনে আগুন লেগে হতাহতের ঘটনায় বিজিএমইএ গভীর দুঃখ প্রকাশ করছে। পাশাপাশি নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা ও আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছে বিজিএমইএ।

প্রধান উপদেষ্টার শোক: মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে একটি পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে অগ্নিকাণ্ডে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল এক শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই দুর্ঘটনায় নিরীহ মানুষের মৃত্যু অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক। আমরা এই শোকের সময়ে তাদের পরিবারের পাশে আছি। ড. ইউনূস অগ্নিকাণ্ডে আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও প্রয়োজনীয় সহায়তার নির্দেশ দেন। 

তারেক রহমানের শোক: মিরপুরে অগ্নিকাণ্ডে ১৬ জনের নিহতের ঘটনায় গভীর শোক জানিয়েছেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। মঙ্গলবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকের এক পোস্টে নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন তিনি। এছাড়া যারা আহত হয়েছেন তাদের দ্রুত সুস্থতাও কামনা করেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।  পোস্টে তিনি লেখেন, বারবার এমন হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা অনেক দুঃখ এবং প্রশ্ন রেখে যায়। আমাদের অবশ্যই কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে নিয়ম মেনে কর্মস্থল পরিচালনার আহ্বান জানিয়েছেন তারেক রহমান। যেন এভাবে দুর্ঘটনায় আর কারও মৃত্যু না হয়।