Image description

বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ২৫ জন বর্তমান এবং প্রাক্তন আর্মি অফিসারদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭৩-এর অধীনে, যা ২০২৪ সালে সংশোধিত হয়েছে।

এ নিয়ে দুইজন বুদ্ধিজীবী দুটি মারাত্মক প্রশ্ন তুলে জনগণের মনে সন্দেহের বীজ বপন করার চেষ্টা করছেন। প্রশ্ন দুটো হলো:

১) মিলিটারি অফিসারদের মিলিটারি আদালতে বিচার না করে আইসিটি বা অন্য কোনও সিভিলিয়ান আদালতে বিচার করা কি বৈধ?
সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ বৈধ।

বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যেমন enforced disappearances বা গুমের জন্য মিলিটারি অফিসারদের সিভিল আদালতে, বিশেষ করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটিতে বিচার করা সম্পূর্ণ বৈধ এবং আইনসম্মত।

এই ধরনের অপরাধের জন্য অফিসারদের মিলিটারি আদালতে বিচার করা বাধ্যতামূলক নয়, কারণ আইসিটি অ্যাক্ট, ১৯৭৩-এর অধীনে এই ট্রাইবুনালের বিশেষ জুরিসডিকশন বা অধিকারক্ষেত্র আছে, যা অন্য কোনো আইন (যেমন আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২)-এর উপর প্রাধান্য পায়।

আইসিটি অ্যাক্টের সেকশন ৩ এবং ৪-এ মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং জেনোসাইডের জন্য জুরিসডিকশন স্পষ্ট করা হয়েছে, যা সামরিক বাহিনী, ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা disciplinary forces-এর সদস্যদেরও অন্তর্ভুক্ত করে। ২০২৪-এর সংশোধনীতে এটি আরও স্পষ্ট করে enforced disappearances-কে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

 

সাধারণ অপরাধের জন্য মিলিটারি অফিসারদের আর্মি অ্যাক্ট অনুসারে মিলিটারি কোর্টে বিচার হয়, কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো গুরুতর ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস-এর জন্য আইসিটি-এর স্পেশাল জুরিসডিকশন প্রাধান্য পায়। এটি সিভিল ওভারসাইট নিশ্চিত করে এবং অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় নেওয়া হয়।
এই পার্টিকুলার বিষয়ে বাংলাদেশের আইসিটি আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেমন আইসিসি স্ট্যাচুট, যা মিলিটারি অফিসারদেরও সিভিল-লাইক ট্রাইব্যুনালে বিচারের অনুমতি দেয়।

২) নিম্ন অফিসারদের ক্রাইমের জন্য তাদের ঊর্ধ্বতন অফিসারদের গ্রেফতার করা কি যায়?
সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ যায়।
বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) মিলিটারি নিম্নপদস্থ অফিসারের অপরাধের (যেমন enforced disappearances বা মানবতাবিরোধী অপরাধ) জন্য উচ্চপদস্থ অফিসারদের গ্রেফতার করে বিচার করতে পারে, যদি তারা কমান্ড রেসপন্সিবিলিটির পোস্টে থাকেন। তারা জেনেও গুম বন্ধ করেননি, নিজে যতই শুদ্ধ হন না কেন, এ ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্বশীলতা এড়াতে পারেন না।

এটি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭৩-এর সেকশন ৪(৩) (২০২৪ সংশোধনীতে বিস্তারিত)-এর অধীনে সম্ভব, যা বলে যে, কোনো কমান্ডার বা সুপিরিয়র অফিসার যদি অপরাধ জেনে বা জানা উচিত ছিল এমন অবস্থায় প্রতিরোধ বা শাস্তির ব্যবস্থা না নেন, তাহলে তারা সেই অপরাধের জন্য দায়ী। উপরের এই ৪(৩) হুবহু আইসিসি কমান্ড ২৮-এর কপি, অর্থাৎ, আইসিসি-এর মতন আন্তর্জাতিক আইনে করা হয়েছে।

সুপিরিয়রের দায়িত্বকে স্পষ্ট করা এই রুলস ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর ইয়ুগোস্লাভিয়া এবং রুয়ান্ডায় একই ধরনের ছিল, যা কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল’র অংশ। বাংলাদেশের অ্যাক্ট এগুলো ফলো করে। এই বিষয়ে বাংলাদেশের আইসিটি ২০২৪ সালে অ্যামেন্ডমেন্ট করে নিজেদের আইনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এনেছে। ২০২৪-এর অ্যামেন্ডমেন্টসকে HRW স্বাগত জানিয়েছে, বলেছে যে এটি কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি এবং ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটির ডেফিনিশনকে স্পষ্ট করে, যা আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের সাথে মিলে।

অতএব, আইসিটি ট্রাইবুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আর ওনার টিম, কোনো ইনকম্পিটেন্স দেখাননি, কোনো গ্লোরি হান্টিং বা ভেন্ডেটা নিয়ে অফিসারদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার দাবি আদালতে করেননি, যা করেছেন তা আইনি এবং সম্পূর্ণ যৌক্তিক আর বৈধ।

বাংলাদেশের র‍্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স-গুম-খুনের সাথে জড়িত ছিল, কেউ তা অস্বীকার করতে পারবে না। তাহলে এসব অফিসারদের বিচার নিয়ে এত খেলো সব প্রশ্ন কেন? গুমের গুরুত্ব স্বীকার করেন, কিন্তু প্রক্রিয়াকে “আবাল তদামি” বলে ট্রিভিয়ালাইজ যিনি করেছেন তিনি আসলে বিষয়ের গ্র্যাভিটি বুঝতে পারেননি। ভুলে যাচ্ছেন যে হাজারো গুমের শিকারদের জন্য জবাবদিহি এবং সুবিচার দরকার।

ফ্যাক্টস আর আইনের বদলে ইমোশনাল অ্যাপিল দিয়ে এসব কেসের উপর পোস্ট লেখা একেবারে নির্বুদ্ধিতা। ঠিক যেমন নির্বুদ্ধিতা ছিলো শাহবাগের প্রাথমিক সময়ে না বোঝা যে বিচার না চেয়ে ফাঁসি চাওয়া হচ্ছে বিচারিক প্রণালি আর আদালত ধ্বংসের সবচেয়ে প্রথম হাতিয়ার। যাদের হাত ধরে তৈরি হয়েছিল ফ্যাসিবাদ।

আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের প্রতি অটল প্রতিশ্রুতি বজায় রেখে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এগিয়ে চলুক, যাতে অতীতের অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠতে পারে। এই প্রক্রিয়া না শুধু শিকারদের ন্যায় দিবে, বরং ভবিষ্যতে এমন অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধ করবে, এবং জাতি হিসেবে আমাদের শক্তিশালী করবে। (মতামত লেখকের নিজস্ব)

লেখক: সাবিনা আহমেদ, মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষক