Image description
 

কৃষক থেকে রাজধানীর খুচরা বাজারে পৌঁছতে পৌঁছতে সবজির দাম বেড়ে প্রায় চার গুণ হয়ে যাচ্ছে। ঘন ঘন হাতবদল, চাঁদাবাজি ও বাজার তদারকির দুর্বলতায় কৃষক থেকে দামের এই পার্থক্য তৈরি হচ্ছে। এতে কৃষকরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না, ভোক্তাদেরও কিনতে হচ্ছে চড়া দামে।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ সমস্যা সমাধানে কৃষি বিপণনকে অনলাইন ও অফলাইন দুটিতেই শক্তিশালী করাসহ বাজারব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে হবে।

বগুড়ার মহাস্থান হাটে কৃষকরা বেগুন বিক্রি করছেন ২৭ থেকে ৪০ টাকা কেজিতে, আর ঢাকায় সেই বেগুন বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৮০ টাকা দরে।

 
 

একইভাবে শিম কৃষক পর্যায়ে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, কিন্তু রাজধানীতে তা ১৬০ থেকে ২০০ টাকা। করলা বগুড়ায় ৩২ থেকে ৩৮ টাকা, অথচ ঢাকায় তা ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

বরবটির ক্ষেত্রেও একই চিত্র—বগুড়ায় দাম ৩০ থেকে ৩২ টাকা, ঢাকায় ১০০ থেকে ১২০ টাকা। পটোল বগুড়ায় ২০ থেকে ২৫ টাকা, আর রাজধানীতে ৭০ থেকে ৮০ টাকা।

ঢেঁড়স মহাস্থান হাটে ২০ থেকে ২৫ টাকা, কিন্তু ঢাকায় তা বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকায়। মিষ্টিকুমড়া কৃষক বিক্রি করছেন ১৭ থেকে ২০ টাকায়, অথচ খুচরা বাজারে দাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি।

লম্বা লাউয়ের দামেও ব্যাপক পার্থক্য—গ্রামে ১৫ থেকে ২৫ টাকা, আর ঢাকায় ৭০ থেকে ৮০ টাকা প্রতি পিস।

কারওয়ান বাজারের একজন সবজি বিক্রেতা বলেন, “কৃষকরা স্থানীয় হাটে সবজি আনেন। সেখানে ফড়িয়া বা পাইকাররা দলবেঁধে দাম নির্ধারণ করে নেয়। তারা সস্তায় কিনে ঢাকায় পাঠায়। পথে কয়েকবার হাতবদল হওয়ার পর খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পৌঁছায়—এই প্রক্রিয়াতেই মূলত দাম বাড়ে।”

তিনি মনে করেন, “যদি কৃষক ও বিক্রেতার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ থাকত, তাহলে মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভ কমে যেত, ফলে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই উপকৃত হতো।”

বগুড়ার একজন কৃষক বলেন, “টানা বৃষ্টিতে এবার উৎপাদন কম হয়েছে। খরচ বেড়েছে, কিন্তু দাম পাই না। সরকার বা কৃষি অফিস কেউ খোঁজ নেয় না। এভাবে আমাদের সংসার চালানো কঠিন।”

কৃষকদের অভিযোগ, মধ্যস্বত্বভোগীরা প্রতি কেজি সবজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা লাভ করেন, আর প্রতিটি লম্বা লাউয়ে ১৫ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত। বাজারে পৌঁছানোর পর এই মুনাফা দুই থেকে চার গুণ বেড়ে যায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বগুড়ার উপ-পরিচালক কৃষিবিদ সোহেল মো. শামসুদ্দিন ফিরোজ জানান, প্রান্তিক কৃষকরা প্রায় সব সময় বঞ্চিত হচ্ছেন। উৎপাদন ও পরামর্শ প্রদানের লক্ষ্যে কৃষি অধিদপ্তর যেমন ‘কৃষক গ্রুপ’ করেছে, তেমনি কৃষকদের ন্যায্যমূল্য পাইয়ে দিতে ‘কৃষি বিপণন’কে গ্রুপ করা প্রয়োজন। কৃষি বিপণনকে অনলাইন ও অফলাইন দুটিতেই শক্তিশালী করাসহ বাজারব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে হবে।

এ বিষয়ে ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভলান্টারি কনজিউমারস ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস সোসাইটির (ভোক্তা) নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান সজল বলেন, “কৃষকের ঘামে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য তারা পান না, অথচ শহরের মানুষ কিনছে কয়েক গুণ বেশি দামে। এই ব্যবধানের মূলে আছে অদৃশ্য, শক্তিশালী এক গোষ্ঠী—মধ্যস্বত্বভোগীরা।”

তিনি আরও বলেন, “একই সবজি যা ঢাকায় ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়, তা কৃষককে বিক্রি করতে হয় ২০ থেকে ২৫ টাকায়। গবেষণায়ও প্রমাণ হয়েছে, সবজি ও শস্যের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের লাভের হার ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত। অর্থাৎ কৃষক তাঁর শ্রমের মূল্য পান না, আবার ভোক্তাকেও দিতে হয় অতিরিক্ত দাম।”

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘আমাদের বিপণনব্যবস্থায় প্রধান সমস্যা হচ্ছে একদিকে কৃষক তাঁর ন্যায্য দাম পান না, অন্যদিকে ভোক্তাদের অতিরিক্ত দাম দিয়ে ভোগ্য পণ্য কিনতে হয়। মূলত বর্তমান বাজারব্যবস্থার কারণে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই ঠকছে, লাভবান হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। এখন বাজারব্যবস্থাকে যদি কৃষকের অনুকূলে নেওয়া যায়, তাহলে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই লাভবান হবে। যেহেতু মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য থাকবে না, আমাদের কৃষকও ন্যায্য দাম পাবেন এবং ভোক্তারাও ন্যায্য দামে পণ্যসামগ্রী কিনতে পারবে। ’