
দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও মামলা অব্যাহত রয়েছে। কোনোভাবেই থামছে না সংবাদকর্মীদের হয়রানি ও নিপীড়নের ঘটনা। এতে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ নানা অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। সংশ্লিষ্টরা এসব মামলাকে হয়রানিমূলক বলে দাবি করেছেন। তাদের অভিযোগ, পেশাগত দায়িত্ব পালন করাকে কেন্দ্র করেই অনেক সাংবাদিককে এসব মামলায় জড়ানো হয়েছে।
সাংবাদিকদের ওপর এ ধরনের হয়রানি ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে একটি ‘পর্যবেক্ষণ কমিটি’ গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, সাংবাদিকদের যেন অযথা মামলায় জড়ানো না হয়—সেজন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এসব মামলার অগ্রগতি বা বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র সর্বশেষ বুধবার (৮ অক্টোবর) সাংবাদিক নিপীড়নের একটি পরিসংখ্যান দিয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসের তথ্য তুলে ধরা হয় পরিসংখ্যানে। এতে বলা হয়, ৯ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ১৯ জন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসীরা ১৪ জন সাংবাদিককে হত্যার হুমকি দিয়েছে। সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে ৬৫টি। বোমা হামলা, নির্যাতন ও হুমকি দেওয়া হয়েছে ৩৭ জনকে। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কর্মীদের হাতে একজন এবং বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে ২১ জন সাংবাদিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
আসকের তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় পার্টি ও তার সমর্থিতদের হাতে দুজন, সরকারি কর্মচারীদের হাতে তিন জন হুমকির শিকার হয়েছেন। ৯ মাসে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ৯০ জন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন। একজনকে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। বৈষম্যবিরোধী আান্দোলনের নেতার হুমকির শিকার হয়েছেন একজন। আরেকজন হামলার শিকার হয়েছেন। একই আন্দোলনের পর এ সময়ে ৫২ জন সাংবাদিক মামলার আসামি হয়েছেন। অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর তিন সাংবাদিকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। অন্যান্য ঘটনায় আরও ৬ জনসহ ৩১৫ জন সাংবাদিক হত্যা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। একই সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ৫৩১ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হন এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন একজন।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) তথ্য অনুযায়ী গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনায় দায়ের হওয়া বিভিন্ন মামলায় কমপক্ষে ১৪০ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়। ২৫ জন সাংবাদিক মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনালের আসামি। এসব মামলায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিক কারাগারে আছেন। তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গত ৫ আগস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৪৯৬ জন সাংবাদিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন এবং একই সময়ে ২৬৬ জন সাংবাদিককে বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে। সাংবাদিকরা বেশি আসামি হয়েছেন ঢাকায় দায়ের হওয়া বিভিন্ন হত্যা মামলায়। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও জেলা-উপজেলা শহরে জুলাই-আগস্টের সহিংসতার ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় সাংবাদিকদের আসামি করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণে গত বছরের ৭ অক্টোবর একটি ‘পর্যবেক্ষণ কমিটি’ গঠন করা হয়। পরে কমিটির পক্ষ থেকে প্রথম সভা করা হয় ওই মাসেরই ২৭ অক্টোবর। কমিটির সভাপতি ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ আলতাফ-উল-আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলার তথ্য চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনকে চিঠি দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই পর্যবেক্ষণ কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘কমিটি গঠনের পর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি জারি করে তিন দফায় মামলার তথ্য আহ্বান করা হয়। বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনকে চিঠি দেওয়া হয়। যাতে যেসব সাংবাদিক মনে করেন, তাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে, সেই মামলার তথ্য দিয়ে কমিটিকে সহযোগিতা করার জন্য। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও চিঠি দেওয়ার পর সারা দেশ থেকে এমন ৭২টি মামলার তথ্য কমিটির কাছে এসেছে।’’
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘‘এসব মামলার মধ্যে কিছু হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। এগুলোর ক্ষেত্রে আইনগত কারণেই তথ্য মন্ত্রণালয়ের কিংবা কমিটির কিছু করার নেই। বাকি যে মামলাগুলো আছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই ঢাকার বাইরের মামলা। যেগুলো স্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও বিরোধের কারণে হয়েছে।’’
তিনি বলেন, ‘‘যদিও ঢালাওভাবে বলা হচ্ছে—সবার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে, যা ঠিক নয়। ঢাকার বাইরেরগুলোর বেশির ভাগই হচ্ছে চাঁদাবাজি ও নানা বিরোধের অভিযোগে মামলা। এসব মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তারা আওয়ামী লীগ আমলে ১৫ বছরে প্রভাব খাটিয়েছে। এখন সুযোগ পেয়ে প্রতিপক্ষ তাদের মামলার আসামি করেছে। এ জাতীয় মামলাই বেশি। প্রায় ৭০ ভাগ মামলাই হয়েছে স্থানীয় বিরোধের কারণে। যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৯০ ভাগই আওয়ামী লীগের কোনও না কোনও পদে আছে। সাংবাদিক, কিন্তু একইসঙ্গে আবার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দলীয় পদে রয়েছেন।’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আরও বলেন, ‘‘এসব মামলার এখনও তদন্ত শেষ হয়নি। তবে কমিটি কয়েক দফা বৈঠক করে মামলাগুলোর বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠিয়েছে। মামলাগুলো তদন্ত করে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত কেউ যাতে কোনোভাবেই অহেতুক হয়রানির শিকার না হন, সে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। এর মধ্য দিয়ে আমাদের কমিটির কাজ শেষ।’’ তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক কারণে মামলা। কিন্তু তারা যেহেতু সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত, সেটাকে দেখানো হচ্ছে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা। এ জাতীয় মামলাই বেশি।’’
ঢাকায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে মুহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে উসকানির উপাদান বা তথ্য আছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে হত্যার যে অভিযোগ, সেটা সরাসরি নেই। কিন্তু উসকানিমূলক বক্তব্যের কারণে কিছু জায়গায় মেরিট আছে। আমরা এসব পর্যালোচনা করে সুপারিশ করেছি—যাতে কারও বিরুদ্ধে অবিচার না হয় এবং কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হন। এ ধরনের সুপারিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’’
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব কাজী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যেসব মামলা তাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল—সেসব মামলায় প্রায় ৩০০ আসামি ছিল। কিন্তু সাংবাদিকদের বিষয়টি যেহেতু তথ্য মন্ত্রণালয় দেখে, সেজন্য সেগুলো আবার তথ্য মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি তারাই দেখবেন।’’
তবে মামলা পর্যবেক্ষণ কমিটির আরেক সদস্য তথ্য অধিদফতরের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা মো. নিজামুল কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এ বিষয়ে আপডেট কোনও তথ্য তার কাছে নেই। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।