Image description

শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আইন ও প্রচার থাকা সত্ত্বেও জনবহুল এই দেশের শ্রম খাতে লাখো শিশু কর্মরত। তাদের অনেকে কঠিন পরিশ্রম ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। শিশুশ্রমিকদের ক্ষেত্রে কাজের ধরন ও কর্মঘণ্টাসংক্রান্ত আইনের বিধিনিষেধ মানা হয় না বললেই চলে। মূলত অনেক কম পারিশ্রমিকে খাটানোর সুযোগ থাকায় কর্তৃপক্ষ শিশুশ্রমিক নিয়োগ করে। সম্প্রতি এই প্রতিবেদক রেস্তোরাঁ, কারখানাসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি কাজের জায়গায় গিয়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু-কিশোরকে নগণ্য পারিশ্রমিকে দীর্ঘ সময় ধরে কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে দেখেছেন।

রাজধানীতে কায়িক শ্রমনির্ভর বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সেখানে কর্মরত শিশুশ্রমিকদের গড় বয়স ১০ থেকে ১৫ বছর। অভাবের তাড়নায় ছোট ছোট হাতগুলো ধরেছে ঝাড়ু, তেলকালিমাখা যন্ত্রপাতি কিংবা লোহা কাটার ভারী যন্ত্র।

মালিটোলার একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করতে দেখা যায় মাত্র ১১ বছর বয়সী সুলতানকে। পরনে মলিন জামাকাপড়, অনবরত পানিতে ভিজে ভিজে সিঁটিয়ে যাওয়া হাতের তালু। সকাল ৮টায় কাজ শুরু হয় সুলতানের, শেষ হয় রাত ১১টায়; যার অর্থ দীর্ঘ ১৫ ঘণ্টার পালা। থালাবাসন ধোয়া, ঝাড়ু দেওয়া, খাবার পরিবেশনসহ সব ধরনের কাজই করতে হয় তাকে। মাসজুড়ে হাড়ভাঙা খাটুনির পর সুলতান বেতন পায় ৬ হাজার টাকা। একজন পূর্ণবয়স্ক কর্মীকে দিতে হতো ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা বেতন। এমনই আরেকজনের সঙ্গে কথা হয় নীলক্ষেত মোড়-সংলগ্ন বাবুপুরার এক রেস্তোরাঁয়। আলভি নামের ১৩ বছরের কিশোরটি দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে মাসে বেতন পায় সাড়ে ৭ হাজার টাকা। বয়সে নবীন আলভির কাছে অবশ্য তা মোটেই খারাপ নয়। এই প্রতিবেদককে সে বলল, ‘আমাকে ভালোই বেতন দেয় তারা। থাকা-খাওয়াসহ সাড়ে সাত হাজার টাকা পাই মাসে।’

ওয়ারী এলাকার বনগ্রাম রোডের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসে কাজ করে ১২ বছরের কিশোর দিদার হোসেন। কথা বলার সময় আপাদমস্তক ধুলো আর তেলকালিমাখা চেহারায় ছিল সে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নানা যন্ত্রাংশ তৈরি আর মেরামত করে মাসে তার আয় মাত্র ৬ হাজার টাকা। দিদার জানাল, মাত্র ৮ বছর বয়সে তার মা এখানে কাজ করতে পাঠান। কারখানার মালিক সম্পর্কে তার মামা হলেও দুই বছর ধরে পারিশ্রমিক বাড়েনি।

ধোলাইখাল এলাকায় জাহাজের পুরোনো ও পরিত্যক্ত মালপত্রের কারখানায় কাজ করে অনেক শিশু-কিশোর। তাদের একজনের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। নাম জানাতে আপত্তি তার, বয়স জিজ্ঞেস করে জানা যায় ১৪ বছর। হাতের বিভিন্ন জায়গায় পোড়া বা কাটাছেঁড়ার ক্ষতচিহ্ন। ছেলেটির কাজ হলো ভারী যন্ত্র দিয়ে জাহাজের লোহা কেটে টুকরো বা সমান করা। বড় লোহার খণ্ড হাত ফসকে পড়ে গেলেই ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। খুব ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজের জন্য বড়দের মাসিক মজুরি যেখানে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা, সেখানে এই কিশোরকে দেওয়া হয় মাত্র ৮ হাজার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, দেশে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন শিশুশ্রমিক আছে। ২০১৩ সালে সংখ্যাটি ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯। বর্তমান শিশুশ্রমিকদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। পরিসংখ্যান বলছে, ১০ বছরের ব্যবধানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রমিকের সংখ্যা দুই লাখের মতো কমেছে।

বিদ্যমান আইনে (শ্রম আইন, ২০০৬) বলা হয়েছে, কোনো পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিশুকে নিয়োগ করা বা কাজ করতে দেওয়া যাবে না। তবে সক্ষমতা থাকা সাপেক্ষে কোনো কিশোরকে তার পিতা-মাতার অনুমতিতে কাজে নিযুক্ত করা যাবে। এই আইনে ১৪ বছর পূর্ণ হওয়া কিন্তু ১৮ বছরের কম বয়সীরা কিশোর হিসেবে বিবেচিত। কিশোরদের অনুমোদিত কর্মঘণ্টার ব্যাপারে বলা হয়েছে, অধিকালসহ কারখানার ক্ষেত্রে সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৩৬ ঘণ্টা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৪৮ ঘণ্টা। অর্থাৎ দিনে ৫ থেকে ৭ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না একজন কিশোরকে দিয়ে।

শ্রম ও কর্মসংস্থানসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান এ বিষয়ে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দেশে শিশু-কিশোরদের শ্রমিক হিসেবে কাজের সুযোগ কোনোভাবেই থাকতে দেওয়া উচিত নয়। আমরা কিছু উদ্যোগ নিচ্ছি। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো, সব খাতেই শিশুশ্রম সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা। প্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলো শিশুশ্রমমুক্ত হলেও আর্থসামাজিক পরিস্থিতির কারণে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলো এখনো মুক্ত হতে পারেনি। নতুনভাবে শ্রম ও কর্মসংস্থান অধিদপ্তর গঠন করা হচ্ছে। আশা করি, এটি কার্যকর হলে ধীরে ধীরে আমরা শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হব।’

এ বিষয়ে শিশু অধিকার কর্মী লায়লা খন্দকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দারিদ্র্যের দোহাই দিয়ে শিশুশ্রমকে বৈধতা দেওয়ার প্রবণতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও শিশুশ্রম পুরোপুরি নির্মূল হয়নি, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। আমাদের এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে একটি শিশুকে এক মিনিটও যেন শ্রমিকের কাজ করতে না হয়।’