
২৩ বছরের টগবগে যুবক আকাশ। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের আন্দোলনে অংশ নিতেন, মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে যেতেন রাস্তায়, মিছিলে। মা জানার পর বলেছিলেন, ‘বাবা তুই আন্দোলনে যাইস না, তোর কিছু হলে আমাকে কে দেখবে? আমি কীভাবে বাঁচব?’
কিন্তু মায়ের নিষেধ না শুনে দেশকে ফ্যাসিবাদমুক্ত করার আন্দোলনে অংশ নিতে থাকেন শ্রমজীবী মায়ের একমাত্র সন্তান আকাশ। ৪ আগস্ট আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সেদিন মিরপুর-১০ নম্বরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান তিনি।
আন্দোলন দমনে তখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল পুলিশ ও আওয়ামী লীগ ক্যাডাররা। তারা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচার গুলি চালাতে থাকে। এতে বিভিন্ন স্থানে পড়তে থাকে লাশ। চোখের সামনে লাশের মিছিল দেখেও আন্দোলন থেকে পিছপা হননি আকাশ।
সেদিন বন্ধুদের সঙ্গে মিরপুর ইসিবি চত্বরে ও পরে মিরপুর-১০ নম্বরে যান তারা। সেখানে মিছিল চলাকালে হঠাৎ পুলিশ গুলি ছোড়া শুরু করলে একেকজন একেকদিকে ছুটতে থাকেন। বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন আকাশ।
হঠাৎ এক বন্ধু দেখেন, দুজন লোক আকাশকে রিকশায় হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। তার মাথায় গুলি লেগেছে। পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে গেলে আইসিইউ লাগবে বলে জানান চিকিৎসকরা। এরপর পাশের একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানের ডাক্তার আকাশকে মৃত ঘোষণা করেন।
মোহাম্মদ আকাশ আহমেদের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার সখিপুর থানার ডিএমখালী ইউনিয়নের মাদবরকান্দি গ্রামে। তবে জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। আকাশের মা বেবি আক্তার আমার দেশকে বলেন, ওর এক বছর বয়সে ওর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যান। মিরপুর-১১ নম্বরে ভাড়া বাসায় থাকতাম। পরে গার্মেন্টে চাকরি নিই। ওকে বাসায় রেখে কাজে যেতাম।
তিনি বলেন, আকাশ একটু বড় হলে স্কুলে ভর্তি করি। কিন্তু স্কুলে ঠিকমতো না গিয়ে বাইরে চলে যেত, ভাঙাড়ি টোকাত সে। ক্লাস ফোরে ওঠার পর একটি কোয়ার্টারে বাসা ভাড়া নিয়ে মেসের লোকজনকে খাবার সরবরাহ শুরু করি।
অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর বাংলাদেশ জার্মান টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করি। পাশাপাশি ফ্রিজ ও এসির কাজও শিখতে থাকে সে। এএসসি পাস করার পরপরই উবার কোম্পানিতে ডেলিভারি দেওয়ার চাকরি নেয় সে। কলেজে ভর্তি হলেও করোনার কারণে লেখাপড়া আর হয়নি।
কান্নারত অবস্থায় আকাশের মা বলেন, প্রতিদিনই বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে যেত। কিন্তু আমি জানতাম না। রাতে সব বন্ধু মেসেজ দিয়ে সকালে একসঙ্গে হতো। আকাশের দুই বন্ধু বাসায় এলে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করি তাদের। কিন্তু কথা শুনত না তারা। সেদিন আকাশকে ফোন দিলে বলে, ‘মা আমি ভাত খেয়েছি, তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে থেকো।’ আমি তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলি তাকে।
আকাশের মা আরও বলেন, ওর জন্য সব সময় আলাদা তরকারি রান্না করতাম। হাঁস, মুরগি, গরুর গোশত ও চিংড়ি মাছ বেশি পছন্দ ছিল তার। গরুর কলিজা, বটও পছন্দ করত। যেদিন মারা যায়, সেদিনও আমি গরুর কলিজা ভুনা করে রেখেছিলাম। কিন্তু ছেলে আর আসেনি।
ফোন করে বলি বাবা, আমি স্বপ্নে দেখেছি তোমাকে পুলিশ ধরেছে। তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি বাসায় আসো। সে বলে, মা তুমি টেনশন করো না, আমাকে পুলিশে ধরেনি, আমি ভালো আছি, আমি একটু পর আসছি বলেই ফোন কেটে দেয়। পরে আবার ফোন করলে আকাশ আর ধরে না।
তিনি বলেন, ৬টায় আকাশের এক বন্ধু ফোন করে বলে, আন্টি, আকাশ মারা গেছে। পুলিশ গুলি করেছে আকাশের মাথায়। আমি চিৎকার দিয়ে কান্নাকাটি শুরু করি। আমার ছোট ভাইকে ফোন করে খবর দিই। লাশ বাসায় আনার পর এত মানুষ এসেছিল যে, মানুষের চাপ সামলাতে গেটে তালা দিতে হয়েছিল। এলাকার সব মানুষ আকাশের জন্য চোখের পানি ফেলেছে।
আমি বলি, আমি শেখ হাসিনার কাছে যাব, আমার ছেলে কী অপরাধ করেছিল। আমার একমাত্র ছেলেকে কেন মারল? আমি কেন সন্তানহারা হলাম? আমাকে মা বলে কে ডাকবে? ওর অফিস থেকে লোকজন এসে কিছু টাকা দেয়, আমিও কিছু টাকা ধার করে লাশ ওর নানাবাড়িতে নিয়ে দাফন করি।
চোখের পানি মুছতে মুছতে তিনি বলেন, অনেক কাপড়-চোপড় কিনেছে, শীত না আসতেই ব্লেজার কিনেছে। কিন্তু সেটা আর পরা হলো না।
আকাশের মায়ের দাবি- তার ছেলে দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। এখন ছেলের জন্য যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু করা হয়। কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা রাস্তার নাম আকাশের নামে করার দাবি জানান তিনি। তিনি চান, ছেলের স্মৃতি যেন অমলিন হয়ে থাকে ইতিহাসের পাতায়।
আকাশের মা বেবি আক্তার বর্তমানে ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগে ভুগছেন। ডান হাতে ব্যথা থাকায় কোনো কাজ করতে পারেন না। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে ঘরবাড়ি, জায়গাজমিবিহীন দিশাহারা মা সরকারের কাছে মাসিক ভাতা ও পুনর্বাসন চেয়ে আবেদন জানিয়েছেন।
আকাশের বন্ধু রাব্বি বলেন, আকাশ খুবই ভালো ছেলে ছিল। সে চিরদিন আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে।