
হুমায়ুন আইয়ুব
প্রভাত রাঙা ভোর। মিটমিট রোদ। নরম আলো। রোদেলা আলোয় প্রতিদিন তিনি আসেন। শাদা শুভ্র জামা-কাপড়, মাথায় লাল রুমাল। জামা-কাপড় আর রুমালের ভাঁজ অনেকটা কবিতার মতো। এমনই ছন্দ মেলানো এক জীবন। তিনি আসেন ফনিক্স সাইকেলে। প্রতিদিন আসেন। আজও এসেছেন। উস্তাদ মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার এসেছেন। পড়াবেন। সবক পড়াবেন। হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে দেবেন। গল্পের ঝাঁপি খুলবেন। কাঁদামাটির মন জমিনে এঁকে দেবেন শক্তি ও সাহসের গল্প।
আমরা তখন উর্দু তেসরি পড়ি। পঞ্চম শ্রেণিতে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের ভাগলপুরের জামিয়া ইসলামিয়া মাজাহিরুল উলুম মাদরাসায়। উস্তাদ মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার এই জামিয়ার তখন নতুন শিক্ষক। কিশোরগঞ্জের জামিয়া এমদাদিয়ার ফাজেল। মেধাবী ছাত্র। সংগঠকও তিনি। উস্তাদে মুহতারামের চলনবলনও বেশ নান্দনিক। চলার ঢং খুবই শৈল্পিক। রুচি, আভিজাত্য, আত্মমর্যাদার উপমা। বড়রা বলাবলি করেন, তিনি এই অঞ্চলের ইলমি প্রতাপশালী ব্যক্তিত্ব। তিনি আল্লামা আজহার আলী আনোয়ার শাহ’র খাদেম। তার বিশেষ অনুরাগী। ভাবশিষ্য। আল্লামা আজহার আলী আনোয়ার শাহ’র চিন্তার ফেরি করেন তিনি। শাহ সাহেবখ্যাত আনোয়ার শাহ’র মতোই তার তেলাওয়াত, জুমার খুতবা ও মিম্বারের বয়ান। আমরা তখন ছোট। এসব শুনি। তবে বুঝি না। যতটুকু মনে পড়ে, উস্তাদ মাওলানা আব্দুস সাত্তারের মুখেই প্রথম শাহ সাহেবের নামের তসবিহ শুনেছি। উবুর হয়ে গিলেছি শাহ সাহেবের নানা গল্প। গল্পের শারাবান তাহুরা।
শিক্ষাবর্ষ শেষ হচ্ছে। বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকের কেন্দ্রীয় পরীক্ষা হবে। আমাদের পরীক্ষার কেন্দ্র বা মারকাজ কুলিয়ারচরের নুরুল উলুমে। ভাগলপুর মাদরাসার মুহতামিম উস্তাদে মুহতারাম মুফতি হাবিবুর রহমান কাসেমী। একজন ফাজেলে দেওবন্দ। ছাত্রদের প্রতি দরদি। উলামায়ে দেওবন্দের পতাকাবাহী। তিনি আমাদের নুরুল উলুমে পৌঁছে দিয়েছেন। মনোযোগের সঙ্গে পড়াশোনা করতে বলেছেন। নানা উপদেশ দিয়েছেন। তবে চূড়ান্ত উপদেশ এবছরের বার্ষিক মাহফিল পরীক্ষার মাঝখানে পড়েছে। তোমরা পরীক্ষার পড়াশোনা রেখে কেউ মাহফিলে যাবে না। আমিও না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল। সে বছর মাহফিলের মুখ্য ব্যক্তি শাহ সাহেব। তিনি বয়ান করবেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মেধাবীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন।
পরের গল্পটি বাবার মুখ থেকে শুনেছি। শাহ সাহেব বয়ান শেষে পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন। পর্যায়ক্রমে আমার নামও এলো। দুটি পুরস্কার। ক্লাসের প্রথম ছাত্র। আবার পুরো মাদরাসার মেধা তালিকায়ও প্রথম। আমার পুরস্কার দুটি বাবা গ্রহণ করেছেন। নিয়েছেন শাহ সাহেব রহ.-এর হাত থেকে। ছেলের অনুপস্থিতিতে বাবার পুরস্কার গ্রহণের বিষয়টিকে শাহ সাহেব আলাদা চোখে দেখেছেন। বাবাকে উৎসাহিত করেছেন ছেলের পড়াশোনার যত্ন নেওয়ার জন্য। বাড়ি ফিরে বাবার সে কী আবেগ, উচ্ছ্বাস আর আনন্দ! পরীক্ষা শেষে বাড়ি এলে বাবা তার মুগ্ধতার কথা শুনিয়েছেন।
কর্মময় জীবনের টুকরো সময় কাটে বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড-বেফাকে। দুরন্ত শৈশব, আবেগি মন, আর মুরব্বিদের ছায়া আমাকে শক্তি জুগিয়েছে। বেফাকের সিলেবাসের উন্নয়ন, সিলেবাসে মাতৃভাষা বাংলার সংযুক্তি আর শিক্ষকদের তালিম-তরবিয়তে গুরুত্ব দিতেন শাহ সাহেব। বেফাক মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জব্বার জাহানাবাদী রহ.-এর সুখ-দুঃখ আর আলাপ-আলোচনার শেষ আশ্রয় ছিলেন শাহ সাহেব। গঠনতন্ত্র মেনে বেফাক পরিচালনা, নানা মুনি, নানা ঋষি ও নানা মতের বেফাকের প্রাণভ্রমরা ছিলেন মাওলানা আব্দুল জব্বার রহ.। মহাসচিবের সুখ-দুখের খুঁটি ছিলেন শাহ সাহেব। বললে বাড়িয়ে বলা হবে না, শাহ সাহেব ব্যক্তি অঞ্চল ও দলের ঊর্ধ্বে উঠে বেফাক পরিচালনা করতেন। বেফাকের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।
আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের বরকতময় বিয়েটাও কিশোরগঞ্জের শহীদি মসজিদে হয়েছে। বিয়ের আকদ করিয়েছেন শাহ সাহেব নিজেই। সেদিনের ¯স্নেহমাখা নসিহত, বিয়ের খুতবা ও দরাজ কণ্ঠের মোনাজাত আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে এখনও।
আমাদের কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের ওয়াজ, বয়ান ও মিম্বর শাহ সাহেব ছাড়া পূর্ণতা পেতো না। বাজিতপুরের হিলচিয়া বাজারের ইসলামিয়া মাদরাসার একাধিক মাহফিলে তিনি এসেছেন। দরদমাখা কণ্ঠে বয়ান করেছেন। এই অঞ্চলের মানুষ তাঁর বয়ান, তেলাওয়াত, বিন্যস্ত কথার জন্য মুখিয়ে থাকতো। আজ ভাব-অনুভবে শাহ সাহেবকে স্মরণ করে মানুষজন।
শাহ সাহেব অসুস্থ। দেশ-বিদেশে চিকিৎসা চলছে। প্রায় শেষ জীবনের খেয়াতরী। মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি। মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা মাহমুদুল হাসান বললেন, চলো! শাহ সাহেবকে দেখে আসি। যাত্রাবাড়ি থেকে মিরপুরের পথে। মুহিউস সুন্নাহর মুখে শাহ সাহেবের জিকরে খায়ের। নানা রকম তাজকিরাহ। ছোটবেলার শাহ সাহেব, ছাত্রজীবনের শাহ সাহেব, কুরআনের পাখি শাহ সাহেব, হাদিসের মসনদের বাদশাহ শাহ সাহেব, হারদুয়ির আশেক শাহ সাহেবসহ নানা বৈচিত্র্যময় আলোচনা শুনছি। বারবার স্মৃতিকাতর হয়ে উঠছেন মাওলানা মাহমুদুল হাসান। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। হাসপাতালে শাহ সাহেবের মেয়ে জামাতা মাওলানা জালালুল ইসলাম নদভি ও শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর ছেলে মাওলানা মাহবুবুল হক অপেক্ষা করছেন।
চলনে-বলনে ও যাপিত জীবনে সুন্নতে রাসুলের খুশবুধারী মাওলানা মাহমুদুল হাসান হাসপাতালের বিছানায় শাহ সাহেবকে দেখলেন। নিথর হয়ে আছে দেহ। নিস্তব্ধ কক্ষ। মলিন চেহারা। আর চারদিকে বিদায়ের সুর। শাহ সাহেবকে দেখে মৃদু আওয়াজে দোয়া পড়লেন মুহিউস সুন্নাহ। ‘আসআলুল্লাহাল আজিম, রাব্বিল আরশিল আজিম, আইয়াশফিয়াক।’ দোয়া পড়ার সময় মাওলানা মাহমুদুল হাসান অনেকটা কাতর হয়ে গেছেন। মন তার ভেঙে গেছে। চোখের কোণে পানি টলমল করছে। কাছে বসে মেয়ে জামাতার কাছে জানতে চাইলেন, আমাকে চিনবে কি শাহ সাহেব? বিছানায় শায়িত শাহ সাহেব নিজেই মুখ খুললেন। বললেন, তোমাকে চিনবো না কেন? অল্প সময়। চোখে মুখে পুরোনো স্মৃতি। ভাবনা বিনিময়। আবেগ প্রবণ হয়ে উঠলেন আনোয়ার শাহ। মাহমুদ সাহেবও স্মৃতিকাতর হয়ে উঠলেন। বিছানায় শোয়া শাহ সাহেব মাহমুদ সাহেবের গলা জড়িয়ে ধরলেন। শুরু করলেন আরবি উর্দু কবিতা। ব্যথা-বেদনা আর বিদায়ের কবিতা। শাহ সাহেবের কণ্ঠে আবেগপ্রবণ কবিতা শুনে মাহমুদ সাহেব কাঁদতে শুরু করলেন। দু’জনের এ আশেকানা মুহূর্তের সাক্ষী আমার চোখ। চোখ বিশ্বাস করছে না দুই মহারতীর কেউ অসুস্থ! গলাগলির এ বেদনা বিধুর সময় বেশ কেটেছে।
শাহ সাহেবের চলে যাওয়ার তিন দিন পর শেষ বিদায় জানাতে মাহমুদ সাহেবের সঙ্গে কিশোরগঞ্জের জামিয়াতে এসেছি। এক অচেনা অপরিচিত জামিয়া দেখে কষ্টে বাড়ি ফিরেছি। বিদায় শাহ সাহেব। বিদায় কুরআনের কোকিল। বিদায় হাদিসে রাসুলের শাহানশাহ। বাদশাহ। ভালো থাকবেন মাটির বিছানায়।
লেখক : সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম, উস্তাদ, শেখ জনূরুদ্দিন রহ. দারুল কুরআন চৌধুরীপাড়া মাদরাসা ঢাকা।