Image description
 

ডিমের দামের হিসাব দিয়ে শুরু করা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক ডজন ডিমের দাম ছিল ৮ দশমিক ৫০ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১ হাজার ৩৪ টাকা। সে হিসাবে প্রতিটি ডিমের দাম পড়ে প্রায় ৮৬ টাকা।

ডিমের দামের হিসাবটি নেওয়া হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমসের গত ২৬ মার্চের প্রতিবেদন থেকে। তখন এই দামই ছিল সর্বোচ্চ। ওয়ালমার্টের ওয়েবসাইটে আজ মঙ্গলবার এক ডজন ডিমের দাম দেখা গেছে ৬ ডলার। দাম ধরে হিসাব করলে গতকাল সোমবার এনসিপি নেতা আখতার হোসেনকে হেনস্তা করতে ডিম নিক্ষেপকারীকে ভালো অর্থই খরচ করতে হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে এই দাম পরিশোধের বিপরীতে দেশের ভাবমূর্তি কতটা মূল্য দিলো?

 
 

দেশের ভেতরে রাজনৈতিক নেতাদের ডিম নিক্ষেপের ঘটনা সম্প্রতি আদালত প্রাঙ্গণেও দেখা গেছে। এখন বিদেশের মাটিতেও কিছু প্রবাসীর দ্বারা এমন ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের আগস্টে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিসে প্রবেশের সময় তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের দিকে ডিম ও পানির বোতল ছুড়েছিলেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগের প্রবাসী কর্মীরা। চলতি মাসের শুরুতে যুক্তরাজ্যের লন্ডনেও মাহফুজ আলমের গাড়ি বহরে আওয়ামী লীগের কর্মীরা ডিম নিক্ষেপ করেন।

 

প্রাচীনকাল থেকেই রাজনীতিতে ডিম নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে আসছে। ইলাস্ট্রেশন: ওয়াশিংটন পোস্ট

প্রাচীনকাল থেকেই রাজনীতিতে ডিম নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে আসছে। ইলাস্ট্রেশন: ওয়াশিংটন পোস্ট

 

 

 

আখতারের ঘটনাটি ঘটলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গেছেন তিনি। একা নয়, গেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে। একটি দেশের সরকার প্রধানের সফরে বাড়তি নিরাপত্তা থাকে। সেটি ভেদ করে ডিম নিক্ষেপের ঘটনা উদ্বেগেরও।

রাজনীতিতে এমন সংস্কৃতি এলো কোথা থেকে? দ্য গার্ডিয়ান, কনভারসেশন ও ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন ঘেটে জানা গেল, ডিম ছোঁড়ার ঐতিহ্য প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে রোমান সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক নেতাদের ওপর থালা-বাটি নিক্ষেপ করা হতো। এলিজাবেথান যুগে (ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ) থিয়েটারে কেউ বাজে অভিনয় করলে দর্শকরা মঞ্চের সামনে পচা ডিম ফেলতেন। এই ডিম ছোঁড়ার সংস্কৃতি পরে রাজনীতির মঞ্চেও প্রবেশ করে।

আধুনিক ইতিহাসে এটি আরও স্পষ্ট। ১৯৭০-এর দশকে অস্ট্রেলিয়ায় বেকারত্ববিরোধী বিক্ষোভে রাজনীতিবিদ মালকম ফ্রেজারের ওপর ডিম নিক্ষেপ করা হয়েছিল। তখন বিক্ষোভকারীরা ফ্রেজারকে বলেছিলেন, ‘এই ডিম তুমি ধনীদের খাওয়াও’। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে ১৯৬০ সালে রিচার্ড নিক্সনের ওপরও একাধিকবার ডিম নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এমন অভিজ্ঞতা থেকে বাদ যাননি যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও। 

রোমান সাম্রাজ্য ও ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথের যুগে ডিম নিক্ষেপ ছিল কেবল অহিংস প্রতিবাদ বা হাস্যরসাত্মক উপায়ে প্রতিক্রিয়া দেখানোর উপায়। কিন্তু আধুনিক কালে এটি যেন সংগঠিত হিংসতায় রূপ নিয়েছে। যেমনটি ঘটছে বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরের রাজনৈতিক অঙ্গনে। প্রবাসে এমন ঘটনা বাংলাদেশিদের ঐক্যকে যেমন নষ্ট করে তেমনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন করে। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে এমন ‘ডিম সহিংসতা’ হলে তাতে ব্যক্তির চেয়ে দেশই বড় ভুক্তভোগী হবে।

নিউ ইয়র্কের ডিম নিক্ষেপ দেশে ভালোই উত্তাপ ছড়িয়েছে। এরই মধ্যে আখতার হোসেনসহ অন্যদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ তুলেছেন, সরকার ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রশাসনের ভেতরের একটি অংশের মদদেই এসব হামলা ঘটছে।

ডিম নিক্ষেপের ঘটনা যে কেবল একপাক্ষিকভাবে ঘটছে বিষয়টা এমনও নয়। কয়েকটি গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত বছরের ১৪ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালত প্রাঙ্গণে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শেখ হাসিনা সরকারের বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ওপর ডিম নিক্ষেপের জন্য হাজির হয়েছিলেন শতাধিক মানুষ। তাদের অধিকাংশই ছিলেন আইনজীবী। গত ২২ এপ্রিল কাশিমপুর ও কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সাবেক মন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাধন চন্দ্র মজুমদার, দীপু মনি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানকে গাজীপুর আদালতে তোলা হয়। সেখানে তাদের ওপর ডিম নিক্ষেপ করেন বিএনপির সমর্থক আইনজীবীরা। গত বছরের ২৮ নভেম্বর হাইকোর্টের এজলাসে ডিম নিক্ষেপ করা হয় এক বিচারপতিকে লক্ষ্য করে।

অর্থ্যাৎ, মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠেছে সাড়ে ১২ টাকা মূল্যের এককেটি ডিম। এটি আমাদের রাজনৈতিক ক্ষতের গভীরতা প্রকাশ করছে।