
বেসরকারি চাকরিজীবী মাহিন। রোববার মেট্রোরেলে করে উত্তরা থেকে সচিবালয়ে যাচ্ছিলেন। সচিবালয় স্টেশনে নামার পর টের পেলেন তার মানিব্যাগ নেই। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মাহিন বলেন, আমি উত্তরা সেন্টার থেকে মেট্রোতে উঠি। এমআরটি দিয়ে এন্ট্রি করি। কিন্তু স্টেশন ত্যাগ করার সময়ই টের পাই আমার কার্ডসহ মানিব্যাগ নেই। আশ্চর্য হলাম, একটু টেরও পেলাম না।
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক খলিলুর রহমান। ক’দিন আগে কাওরান বাজারের কর্মস্থল থেকে মেট্রোরেলে মিরপুরে বাসায় ফিরছিলেন। ফার্মগেটে আসার পরপরই পকেট থেকে চুরি হয়ে যায় তার স্মার্টফোনটি। ওই সাংবাদিক বলেন, আমি অফিস থেকে বের হয়ে মেট্রোতে উঠি। লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম যখন, তখনো ফোনে কথা বলে তা পকেটে রাখি। কাওরান বাজার স্টেশন থেকে ফার্মগেট যেতে যেতেই ফোন চুরি হয়ে যায়। কাউকে দোষারোপও করতে পারিনি। কারণ মেট্রোতে অনেক ভিড় ছিল। পরে নেমে এমআরটি পুলিশের সহায়তা নিতে চাইলে তারা জিডি করতে বলেন সংশ্লিষ্ট থানায়। এরপর জিডি’র কপি দেখিয়ে মেট্রোরেলের প্রধান কার্যালয় থেকে সিসি টিভি ফুটেজ নিতে বলেন। কার্যত তারা আমাকে ফোন ফিরে পেতে সহযোগিতা করতে পারেনি।
মেট্রোরেলে এমন ঘটনা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। মোবাইল-মানিব্যাগ চুরির ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। রাজধানীর নাগরিকদের চলাচলের জন্য আরামদায়ক ও স্বস্তির গণপরিবহন মেট্রোরেল। প্রায় ২০০ বার উত্তরা-মতিঝিল-উত্তরা রুটে যাতায়াতের মাধ্যমে আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজধানীতে যাত্রী পরিবহন করছে মেট্রোরেল। যাত্রীর সংখ্যা রোজ বাড়ছে। একইসঙ্গে বাড়ছে পকেটমারের আতঙ্ক। ট্রেনের ভেতর তীব্র ভিড়ে এখন প্রায়ই শোনা যাচ্ছে মোবাইল-মানিব্যাগ চুরির ঘটনা। যাত্রীরা প্রায়শই অভিযোগ করছেন। চুরির ঘটনা লক্ষ্য করেছে মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডও। তাই নিয়ম করে এখন মেট্রোরেলের যাত্রীদের জন্য সচেতনতামূলক রেকর্ড শোনানো হয় ট্রেনে। প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলেও জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
যাত্রীরা বলছেন, এখন মেট্রোরেলের সিঁড়ির গোড়ায় জটলা বেঁধে অবস্থান করে পকেটমাররা। ওত পেতে থাকে তারা। মেট্রোরেল ভ্রমণের পর যাত্রীরা বেরিয়ে আসার পথে পকেট থেকে মোবাইল/ মানিব্যাগ নিয়ে নেয়। তাছাড়া, মেট্রোরেলের ভেতরে তীব্র ভিড় লেগে থাকে সবসময়। সেই সুযোগও নেয় পকেটমাররা। তীব্র ভিড়ে যাত্রীরা মেট্রোর হাতল ধরে হাত উপরে তুলে রাখলে খুব সুচতুরভাবে চুরির কাজটি করে। মেট্রোরেলে নিরাপত্তার জন্য কাজ করা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানিয়েছে, তাদের সামনে সাধারণত এমন ঘটনা ঘটে না। এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা লক্ষ্য করলে তারাও অপরাধীদের ধরার চেষ্টা করেন। তারা বলছেন, মোবাইল ও মানিব্যাগ চুরির ঘটনাগুলো সাধারণত মেট্রোরেলের বগির ভেতরে এবং মেট্রোতে উঠানামার লাইনে ঘটে। গণেশ নামের এমআরটি পুলিশের একজন এসআই মানবজমিনকে বলেন, এই ধরনের ঘটনা ঘটে, তবে আমাদের সামনে ঘটতে দেখা যায় না। বগির ভেতর ও লাইনে এসব ঘটনা ঘটে। অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেই। নারী বগিতে নিরাপত্তার জন্য একজন নারী পুলিশ সদস্য রয়েছেন। পুরুষ বগিগুলোর জন্য একজন পুলিশ কাজ করেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এখন নারী পকেটমারও বের হয়েছে। সেদিন নারীদের বগি থেকে এক নারীর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ছোট আরেকটি ব্যাগ চুরি করে নেয়ার অভিযোগও আমাদের কাছে এসেছে। মেট্রোরেলে চলাচলকারী যাত্রীরা এখন পকেটমারের আতঙ্কে থাকেন। ঢাকার অন্যান্য গণপরিবহনের মতো মেট্রোরেলে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা। মেট্রোরেল সংক্রান্ত সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপগুলোতে তুলকালাম করছেন কেউ কেউ। আসিফ শিবলী নামের একজন বলেন, মেট্রোরেলে এখন পকেটমারের অনেক উপদ্রব বেড়ে গেছে। হোসাইন রিফাত নামের একজন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেন, মেট্রোরেলে পকেটমার ও চোরের উপদ্রব বেড়েছে। দেখা গেছে, ধরা পড়া ওই ব্যক্তিরাই সংঘবদ্ধ হয়ে জামিনে মুক্ত হয়ে আবার এসব অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। তাই এদের ছবি সব স্টেশনে বড় করে টানিয়ে দেয়া হোক। যাতে এদের দেখলেই সবাই সতর্ক হয়ে যায়। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে তাদের ভেতরে ঢুকতে না দেয়। মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী সাজ্জাদ হোসেন। মতিঝিল থেকে নিয়মিত কাওরান বাজারের অফিসে আসেন মেট্রোরেলে। তিনি বলেন, মেট্রোরেলে রোজ যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু, চুরির ঘটনাগুলো এখন বাড়তি উদ্বেগে রেখেছে আমাকে। কেননা, স্বস্তির সঙ্গে কিছুটা নিরাপদে যাতে যাতায়াত করতে পারি সেজন্য বাড়তি খরচ হলেও মেট্রোরেলে যাতায়াত করি। এখন মেট্রোরেলে যেভাবে চুরির ঘটনা ঘটছে, এখানেও নিরাপদ ভ্রমণের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) বলছে, বিষয়টি তাদেরও নজরে এসেছে। তাই মেট্রোতে বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য তারা কাজ করছেন। বিশেষ করে বাড়তি সিকিউরিটি স্টাফসহ সিসিটিভি ক্যামেরার সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছে ডিএমটিসিএল। ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের মধ্যে এ বিষয়ে সভাও করেছে বলে জানিয়েছে কর্মকর্তারা। মেট্রোরেলের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, বিষয়টি আমরাও দেখেছি। কিন্তু যেহেতু মেট্রোরেল আগের সরকারের আমলে তৈরি করে দেয়া একটি ব্যবস্থা, এখানে আগে যেমন নিরাপত্তা ছিল এখন কমে গেছে। কারণ এখন নিরাপত্তার জন্য আগে যে পরিমাণ স্টাফ ছিল সে পরিমাণ স্টাফ এখন নেই। আমরা আরও বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা দেয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে বলেছি। এটি প্রক্রিয়াধীন আছে। খুব দ্রুত এটা টেন্ডার হয়ে যাবে হয়তো। স্টাফ বাড়ানোর বিষয়ে কথা হয়েছে।
অন্যদিকে, মেট্রোরেলের যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়েছে এমআরটি পুলিশ। পুলিশ বলছে, তারা চেষ্টা করেন যাত্রীদের চুরি হওয়া জিনিসপত্র উদ্ধার করে দিতে। তবে এ বিষয়ে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের যথাযথ সহযোগিতা পাচ্ছে না পুলিশ। এমআরটি পুলিশের প্রধান ডিআইজি সিদ্দিকী তানজিলুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, আমাদের কাছে যেসব রিপোর্ট আসে সেগুলো আমরা স্থানীয় থানাকে অবহিত করে থানার মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি। এখানে সমস্যা হচ্ছে- প্রথমত, মেট্রোরেলের সবকিছুর সিসিটিভি ফুটেজ আছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু তারা আমাদের সিসিটিভি ফুটেজ চাইলেও দেয় না। তারা বলেন, জিডির কপি লাগবে, এটা-ওটা লাগবে। এভাবে করে তারাই কালক্ষেপণ করে। কিন্তু একজন ভুক্তভোগী এসেই বলেন, আমার ফোন চুরি হয়ে গেছে, তখন আমাদের দ্রুত ফুটেজ দরকার হয়। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে ফুটেজ দেয় না। জিডি’র কপি দিতে দিতে চোর চলে যায়, যাকে আমি ফুটেজ দেখে শনাক্ত করতে পারি। পরে ফুটেজ পেয়ে লাভ কি? লাখ লাখ মানুষ মেট্রোতে চলে। পরে ফুটেজ থেকে শনাক্ত করলেও চোরকে ধরা প্রায় অসম্ভব। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ চাইলেই প্রতিটি যাত্রীর একক ছবি শনাক্ত করে যাত্রীদের মেট্রোতে নিতে পারে। তারা সেটাও করে না। অন্য একটি সমস্যা হচ্ছে, আমরা চোরদের ধরতে পারলেও অনেকেই মামলা করতে চায় না। কারণ, তাদের চেহারা ও বাহ্যিক দিক এমন হয় যে, মানুষজন মামলা করতে ভয় পায়।