Image description
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেলের ভরাডুবিতে বিস্মিত বিএনপি। দলটির নেতাকর্মীরা এমন শোচনীয় পরাজয়ের ন্যূনতম প্রস্তুত ছিল না। কেউ কেউ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুললেও অনেকেই মোটা দাগে নিজেদের ব্যর্থতার দিকেই আঙুল তুলছেন। তারা বলছেন, নির্বাচনে প্রতিপক্ষের কৌশলের কাছে ধরাশয়ী হয়েছেন তারা। তাদের পাল্টা কোনো কৌশল ছিল না। পুরো নির্বাচনজুড়ে সমন্বয় ছিল না কোথাও। ছাত্রদলের কোনো সাংগঠনিক ভিত্তিই ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর এ কারণেই বিপর্যয় ঘটেছে গুরুত্বপূর্ণ এই নির্বাচনে। এখন সবকিছুর মূল্যায়ন করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগামী প্রস্তুতি নেয়ার কথা বলছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
 
 

গত মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে শীর্ষ তিন পদসহ ৯টি সম্পাদকীয় পদে বিজয়ী হয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল। বাকি তিনটি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। কোনো পদেই ছাত্রদলের প্যানেলের নেতারা জয়লাভ করতে পারেনি। অন্য দিকে ভোটের ব্যবধানও ছিলো অনেক।

page-top-ad
 

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে দেশের দ্বিতীয় সংসদ হিসেবে বিবেচিত ডাকসু নির্বাচনে অভাবনীয় পরাজয়কে খুব সিরিয়াস হিসেবে নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। মুখে তেমন কিছু না বললেও পর্দার অন্তরালে পরাজয়ের কারণ খুঁজছেন তারা। তবে জাতীয় নির্বাচন ব্যাহত হয় কিংবা বাধাগ্রস্ত হয় এমন আশঙ্কায় প্রকাশ্যে কোনো কিছু বলতে নারাজ দলটি।

 
 

বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, ডাকসু নির্বাচনের জন্য ছাত্রদল মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ছাত্রদলের জন্য অনুকূল পরিবেশও ছিল না। ৫ আগস্ট পরবর্তী সারা দেশে মব কালচারের শিকার হতে হয়েছে ছাত্রদলকে। স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখতে তারাও ক্যাম্পাসে নিয়মিত ছিল না। দল সমর্থিত শিক্ষকরাও এই নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তবুও কারা এবং কেন এই নির্বাচনে ছাত্রদলকে টেনে নিয়ে গেলো তা খোঁজা হচ্ছে।

 

ছাত্রদল নেতাকর্মীরা স্বীকার করেন, ছাত্রশিবির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় সাধারণ শিক্ষার্থীসহ নারী ভোটারদের মন জয় করতে কাজ করেছেন। বিভিন্ন সেক্টরে আলাদা আলাদা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছেন ওই সংগঠনের নেতাকর্মীরা। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের স্টেকহোল্ডার হিসেবে নিজেদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে অবস্থান সুসংহত করতেও সক্ষম হয়েছে সংগঠনটি। পক্ষান্তরে ছাত্রদলের কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। নিজেদের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। শিক্ষক, সংবাদ মাধ্যমের সাথেও কোনো আলাদা সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। এর সাথে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভরাডুবি ঘটিয়েছে।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব : ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা জানান, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে অন্যান্য ছাত্র সংগঠন পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও ছাত্রদল ছিল নির্বিকার। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর তোড়জোর শুরু করে প্যানেল গঠন করেন দায়িত্বশীল নেতারা। অল্প সময়ে প্যানেল গঠন করায় বিভিন্ন গ্রুপকে এক প্লাটফর্মে আনতে পারেনি সংগঠনটি। আবার এই নির্বাচনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দলের প্রত্যেক স্তরের নেতাকর্মী আর সমর্থকদের পাশে টানতেও পারেনি। শুধু প্রার্থীদের ব্যক্তি ইমেজকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেয়েছে সংগঠনটি। শিক্ষক, নারী ভোটার কিংবা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ সেতু ছিল দুর্বল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়ার সাথেও তাদের সম্পর্ক ছিল অতি সাধারণ মানের। মূলত দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনাই ছিল না এই সংগঠনটির।

অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসও ডুবিয়েছে সংগঠনকে। ছাত্রদলের শীর্ষ নেতারাসহ বিএনপির দায়িত্বশীলরা মনে করেছিলেন- ঢাবিতে সবচেয়ে মেধাবী আর সচেতন শিক্ষার্থী। এরা কখনোই একটি ইসলামী সংগঠনকে সমর্থন দেবে না। ছাত্রশিবিরের নির্দিষ্ট ভোট ব্যাংকের বাইরে তারা ভোট পাবে না বলে অঙ্ক কষেছিল। কিন্তু তা বুমেরাং হয়েছে।

সমন্বয়হীনতা ভুগিয়েছে : ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের সমন্বয়হীনতা ছিল প্রকট। ঢাবি ছাত্রদলের সাবেক ছাত্রনেতা-কর্মী, সমর্থকদের মধ্যে কোনো সমন্বয় গড়ে তুলতে পারেনি সংগঠনটি। বিক্ষিপ্তভাবে আর জোড়াতালি দিয়ে সব কাজ শেষ করার চেষ্টা হয়েছে। যে যার গ্রুপের নেতাকে জয়ী করতে কাজ করেছেন। কিন্তু সমন্বিত প্যানেলকে জেতাতে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। নেতাকর্মীরা জানান, ঢাবিতে বিএনপিপন্থী সাদা দলের শিক্ষকদের কাজে লাগাতে পারেনি ছাত্রদল। নির্বাচনের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি কর্মসূচি পালন করে সংগঠনটি। সেখানে সাদা দলের শিক্ষকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। প্যানেল ঘোষণার আগেও শিক্ষকদের মতামত নেয়া হয়নি। তাদের এড়িয়ে যাওয়ার ঘটনায় শিক্ষকরা ছাত্রদলের পাশে সেভাবে এগিয়ে আসেননি।

আর্থিক দুর্বলতা আর শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচি অনুপস্থিত : জানা গেছে, প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার জন্য আর্থিকভাবে সেভাবে সাপোর্ট দেয়া হয়নি। আবার জুলাই-আগস্ট পরবর্তী ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের ধারাবাহিক অনুপস্থিতি, শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচি না থাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে পায়নি সংগঠনটি। নেতাকর্মীরা জানান, ছাত্রদলের যেসব নেতাকর্মী নিজস্ব উদ্যোগে ক্যাম্পাসে কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করেছিল তাদেরও কেন্দ্র থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাধা দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। কেন্দ্রের বক্তব্য ছিল- কোনো ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হলে তার দায়ভার ওই নেতাকে নিতে হবে। কেন্দ্রের এমন মনোভাবে অনেক ছাত্রনেতাই নিজেদেরকে গুটিয়ে নেন।

বিতর্কিত আর দুর্বল হল কমিটি : নির্বাচনের কয়েক দিন আগে ঘোষিত হল কমিটি নিয়ে সংগঠনের মধ্যেই তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। বিতর্কিত এই কমিটি হলো নির্বাচনে শক্ত কোনো অবস্থানই সৃষ্টি করতে পারেনি। হলে শক্ত অবস্থান না থাকায় ডাকসু নির্বাচনেও প্রতিপক্ষের কৌশলের কাছে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি সংগঠনটি।

নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক নেতা বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল বিএনপির জন্য একটি বার্তা। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে না পারলে তার খেসারত আগামীতেও দিতে হবে। ওইসব নেতা বলেন, ছাত্রসংগঠনগুলো ঢেলে সাজাতে হবে। মেধা আর সততার রাজনীতি করতে হবে। পুরনো ক্যাসেট বাজিয়ে লাভ হবে না। একইসাথে দল পুনর্গঠনে পুরনো সিন্ডেকেট ভেঙে দিতে হবে।