
নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধনের আবেদন করেছিল ১৪৪টি নতুন রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে গিয়েছিল ২২টি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে খোঁজ-খবর নিয়ে এসব দলের কার্যালয়, জেলা ও উপজেলা কমিটি, সমর্থন করা ভোটার, এমনকি কেন্দ্রীয় কমিটিরও হদিস পায়নি ইসি। সম্প্রতি সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে জমা হওয়া নথি পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
কর্মকর্তারা তদন্তে গিয়ে অনেক দলের দেওয়া ঠিকানা শনাক্ত করতে পারেনি। কোনো কোনো দল নিবন্ধনে টিকতে ঘণ্টা চুক্তিতে কার্যালয় ভাড়া নেয়। পরিস্থিতি এমনÑতদন্ত কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ঘণ্টা চুক্তির সময় শেষ হওয়ায় ব্যানার খুলে নিয়ে যান বাড়ির মালিক। এছাড়া প্রতিটি কমিটিতে ২০০ ভোটারের স্বাক্ষরিত তথ্যে গরমিল পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
আমার দেশ গত কদিন নতুন রাজনৈতিক দল নিয়ে ইসির তদন্ত রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে আরো বেশকিছু ত্রুটি ও অসংগতি খুঁজে পেয়েছে। পূর্বাঞ্চলের একটি জেলা, যার আদ্যাক্ষর ‘এন’। এই জেলায় কার্যালয় ও কার্যক্রম থাকার দাবি করা চারটি দল হচ্ছেÑবাংলাদেশ আম জনগণ পার্টি, মৌলিক বাংলা, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) ও আমজনতার দল। রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, খাবার পানির কারখানাকে পার্টির অফিস হিসেবে দেখিয়েছে আমজনতার দল। এই কারখানা থেকে বিভিন্ন দোকানে পানি সরবরাহ করা হয়। একইভাবে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ নামে সংগঠনের আহ্বায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের দল জনতা পার্টি বাংলাদেশের কার্যালয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়া যাদের দলের সদস্য করা হয়, তাদের সঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তা যোগাযোগ করলে অনেকেই ক্ষিপ্ত হয়ে দুর্ব্যবহার করেনÑএমন অভিযোগও আছে। তদন্ত কর্মকর্তাকে দু-একজন জানান, তারা নিরাপদ সড়ক চাই নামে সংগঠনের সঙ্গে থাকলেও দলে নেই। এমনকি ইলিয়াস কাঞ্চনের স্বাক্ষরও নেই নথিতে।
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (মার্কসবাদী) সাংগঠনিক কিছু কার্যক্রমের অস্তিত্ব পেলেও অফিস ভাড়ার চুক্তি, কমিটি গঠন-সংক্রান্ত কোনো বৈধ কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর বাড়ির মালিকের সঙ্গে ঘণ্টা চুক্তিতে অফিস নেয় মৌলিক বাংলা। তদন্তে উল্লেখ করা হয়, যখন ইসির কর্মকর্তারা সেখানে পৌঁছান, তাদের উপস্থিতিতে ঘণ্টা চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় টানানো ব্যানারটি খুলে নিয়ে যান মালিক। শুধু বাংলাদেশ আমজনগণ পার্টির ভাড়া করা কার্যালয়, ভাড়ার চুক্তি এবং দলের অস্তিত্ব ও কার্যালয় আছে বলে ওই জেলার প্রতিবেদনে পাওয়া যায়। তবে বাকি অনেক জেলায় দলটির কার্যক্রম-সংক্রান্ত তথ্যে ব্যাপক অসংগতি আছে বলে ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সিলেট জেলার চিত্রও একই পাওয়া যায়। এ জেলার একটি উপজেলার নামের আদ্যাক্ষর ‘আ’; সেখান থেকে পাঠানো প্রদিবেদনে দেখা যায়Ñআবেদন অনুযায়ী ঠিকানায় গিয়ে জনতার দলের কোনো কার্যালয়ের হদিস পাওয়া যায়নি। উপজেলা কমিটির যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, তার সদস্যদের প্রয়োজনীয় নথি যাচাই করেও তাদের শনাক্ত করা যায়নি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দলীয় কার্যালয়ের অস্তিত্ব ও কার্যক্রম সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলেও ওই জেলার একটি উপজেলার প্রতিবেদনে পাওয়া যায়। পদ্মার দক্ষিণ পাড়ের আরেকটি জেলায় কার্যালয় ও কার্যক্রম থাকার দাবি করা পাঁচটি দলের মধ্যে শুধু এনসিপির কার্যালয়ের অস্তিত্ব পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা। বাকি জনতা পার্টি বাংলাদেশ, সলুশন পার্টি, ফরওয়ার্ড পার্টি ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) কোনোটিরই দলীয় কার্যালয় বা কমিটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদন দিয়েছে ইসিতে। আরেকটি জেলার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এখানের ফরওয়ার্ড পার্টি, মৌলিক বাংলা ও বাংলাদেশ সলুশন পার্টি সম্পর্কে ইসিতে পাঠানো প্রতিবেদনে দলগুলোর দাবির সঙ্গে কোনো মিল পাওয়া যায়নি। মৌলিক বাংলার ওই জেলা কার্যালয়ের ও দলীয় কমিটির অস্তিত্ব নেই। সলুশন পার্টির বাড়ি ভাড়ার চুক্তিতে থাকা স্বাক্ষরটিও ভুয়া। দলীয় কার্যালয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই। ফরওয়ার্ড পার্টির অবস্থাও অনুরূপ।
মুন্সীগঞ্জের একটি উপজেলা থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সলুশন পার্টি ও বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদের দাবি করা ঠিকানায় কার্যালয় ও দলীয় কমিটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। দলগুলোর সরবরাহ করা ২০০ ভোটারের তালিকার ২০ জনের তথ্য যাচাই করলে তাও ভুয়া প্রমাণিত হয়।
এদিকে প্রাথমিক বাছাইয়ে টিকে যাওয়া এই ২২ দলের বিষয়ে গত ৩১ আগস্ট ইসির মাঠ পর্যায়ের কর্তাদের পাঠানো তথ্য সমন্বয় করে শর্টলিস্ট তৈরি করেছে ইসি সচিবালয়। সে তালিকার তথ্য ৮ সেপ্টেম্বর আমার দেশ-এর হাতে আসে। সেখানে দেখা যায়, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-শাহজাহান সিরাজ), বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ বেকার সমাজ (বাবেস), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি, জেলা ও উপজেলা কার্যালয় এবং সংশ্লিষ্ট কমিটির তথ্য নেই। তবে ভাসানী জনশক্তি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি, শর্ত অনুযায়ী ন্যূনতম ২২ জেলার মধ্যে ৭টি, ১০০ উপজেলার মধ্যে ৮৫টির তথ্য দাখিল করেছে দলটি।
একইভাবে ফরওয়ার্ড পার্টির ৮টি জেলা ও ৬৮ উপজেলা, আমজনতার দলের যথাক্রমে ৬টি ও ৬৩টি, বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদের ১১টি ও ৯৩টি, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি (মার্কসবাদী) (এম) ৬টি ও ৪৭টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি) ৯টি ও ৭৩টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) ৮টি ও ৬২টি, মৌলিক বাংলা ১০ ও ১৭টি, বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ৭ ও ৪৮টি, বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি) ৮ ও ৭৫টি, জনতার দলের ৯ ও ৮৪টি, বাংলাদেশ সলুশন পার্টির ১৪ ও ৭৯টি, নতুন বাংলাদেশ পার্টি ৪ ও ৩৬টি, বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টির ১৯ জেলা ও ৯৩ উপজেলা এবং এনসিপি ১৩ জেলা ও ৮৮টি উপজেলা কার্যালয় কমিটির তথ্য পেয়েছে ইসি। তবে জাতীয় জনতা পার্টির শুধু কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য পেয়েছে ইসি।
এসব দলের মধ্যে নিবন্ধন পাওয়ার ক্ষেত্রে এনসিপি কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনি গ্রুপের বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টির ৯৩টি উপজেলার ২০০ ভোটারের স্বাক্ষরিত তথ্য ইসির বাছাই করা ২০টির মধ্যে কোনোটিতে ১৭টি, কোনোটিতে ১৮টি, কোনোটিতে ৭টির তথ্য সঠিক। অর্থাৎ, বাকি ভোটারের স্বাক্ষর ভুয়া। শুধু বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টিই নয়, অপর দলগুলোর চিত্রও একই বলে ইসির নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার আমার দেশকে বলেন, দলগুলোর বিষয়ে ইসির মাঠ অফিসের তথ্য নিয়ে আমরা সংক্ষিপ্ত তালিকা করেছি। সব পর্যালোচনার পর চূড়ান্ত তালিকা করা হবে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই সব চূড়ান্ত করে নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ করা হবে।