
যশোরের নওয়াপাড়া মোকামের ব্যবসা কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র নদীবন্দর ও শিল্পশহর নওয়াপাড়ায় মন্দাভাবের কারণে ঝুঁকিতে পড়েছেন হাজার হাজার শ্রমিক ও তাদের পরিবার। এর ফলে কৃষি ও শিল্পোৎপাদনের ওপর পড়তে পারে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর নতুন করে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা একটি চক্রের দৌরাত্ম্য, যশোর-খুলনা মহাসড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়া ছাড়াও অর্থের প্রবাহ কমে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য কমেছে চোখে পড়ার মতো। তবে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে বলে দাবি করে জেলা পুলিশ বলছে, ব্যবসায়ীদের সহায়তা পেলে তাদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব হবে। আর যশোর-খুলনা মহাসড়ক সংকটের দ্রুত সমাধান তাদের হাতে নেই বলে জানাচ্ছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
যশোরের নওয়াপাড়া হলো এমন একটি জায়গা, যেখানে নৌ, সড়ক ও রেলপথের সুবিধা রয়েছে। গত শতাব্দীর নব্বই দশকে কুখ্যাত এরশাদ শিকদার ও তার বাহিনীর ক্রমাগত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে খুলনা থেকে অনেক ব্যবসা যশোরের নওয়াপাড়ায় স্থানান্তর হয়। এর মধ্যে বিদেশ থেকে আমদানি করা সার, কয়লা, গম, ভুট্টা, বিভিন্ন ধরনের ডালসহ খাদ্যপণ্য দেশের প্রায় অর্ধেক জেলায় সরবরাহ করা হয় মূলত নওয়াপাড়া থেকে। চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দরে আসার পর এসব পণ্য লাইটার জাহাজে নওয়াপাড়া নদীবন্দরে আসে। সেখান থেকে নৌপথ ছাড়াও রেল ও সড়কপথে পণ্য পাঠানো হয় সুদূর পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও পর্যন্ত। এই বিপুল কর্মযজ্ঞের জন্য নওয়াপাড়াকে কেন্দ্র করে যশোর জেলার শেষ সীমানা রাজঘাট থেকে চেঙ্গুটিয়া পর্যন্ত প্রায় ৬-৭ কিলোমিটারজুড়ে ভৈরব নদের তীরে গড়ে উঠেছে বেসরকারি অর্ধশতাধিক নৌঘাট।
ফ্যাসিবাদী শাসনামলে নওয়াপাড়ার হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর আওয়ামীপন্থিদের প্রভাব ছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। বিএনপি নওয়াপাড়া পৌর কমিটির তখনকার সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান জনির নেতৃত্বে একের পর এক বেসরকারি ঘাট দখল হয়ে যায়। ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায়, বাকিতে পণ্য নেওয়ার নামে টাকা আত্মসাৎ করা, পাওনাদারের কাছ থেকে টাকা আদায়ে মধ্যস্থতা করার নামে বখরা আদায়, পণ্যবোঝাই ট্রাক লুটের মতো বেশকিছু ঘটনা ঘটে জনি ও তার অনুসারীদের দ্বারা।
এর মধ্যে শাহনেওয়াজ কবীর টিপু নামে এক ব্যবসায়ীকে বালুর মধ্যে পুঁতে চার কোটি টাকার চেক আদায়ের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এর আগে গত মে মাসে গুলি করে ও মাথা থেঁতলে নৃশংসভাবে খুন করা হয় নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি তরিকুল ইসলামকে। দৃশ্যত মাছের ঘেরের ব্যবসা-সংক্রান্ত জটিলতায় তরিকুল খুন হলেও তিনি নওয়াপাড়া সার ব্যবসায়ী সমিতির নেতা ছিলেন।
এছাড়া গত বছরের ৫ আগস্টের পরপরই আবু সাইদ সরকার নামে এক ব্যবসায়ীর ওপর হামলা করা হয়। নওয়াপাড়ার সবচেয়ে বড় কয়লা ব্যবসায়ী সরকার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদ সরকার এ ঘটনার পর নওয়াপাড়া ছেড়ে ঢাকায় স্থায়ীভাবে অবস্থান নেন। গ্রুপটির ব্যবসা-বাণিজ্যও আস্তে আস্তে নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ওই ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশের পর পদ হারান আলোচিত বিএনপি নেতা আসাদুজ্জামান জনি।
গত জুলাইয়ে বোমা হামলা হয় দেশের সবচেয়ে বড় সার ব্যবসায়ী নওয়াপাড়া গ্রুপের কার্যালয়ের সামনে। এসব ঘটনায় ব্যবসায়ীরা ভীষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। যার প্রভাব পড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে। সম্প্রতি নওয়াপাড়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের হাল সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেসরকারি পর্যায়ে দেশে সার আমদানির ৫৫ শতাংশের মতো হয় নওয়াপাড়া গ্রুপের হাত দিয়ে। এছাড়া বিসিআইসি ও বিএডিসির সার পরিবহনে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান নওয়াপাড়া গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি ৬২-৬৩ জেলায় সার সরবরাহ করে। এর মধ্যে তাদের নওয়াপাড়া কার্যালয় থেকে সার যায় ৩৫টিরও বেশি জেলায়। এছাড়া সার ব্যবসায় মোশাররফ ব্রাদার্স, বাল্ক ইন্টারন্যাশনাল, শেখ ব্রাদার্স বড় প্রতিষ্ঠান। আমদানি করা কয়লা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকায় আছে জেএইচএম, উত্তরা গ্রুপ, সাহারা গ্রুপ ও সরকার গ্রুপ। কয়লা, গমসহ খাদ্যপণ্য সরবরাহে নাবিল গ্রুপ শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে প্রায় ৩০০ ব্যবসায়ী নওয়াপাড়ার এই বিপুল বাণিজ্যের অংশীদার।
নওয়াপাড়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে প্রায় ৫০ হাজার হ্যান্ডলিং শ্রমিক, ১২ হাজার পরিবহন শ্রমিকসহ লক্ষাধিক কর্মজীবী ও তাদের পরিবার। ব্যবসার মন্দাবস্থায় এসব শ্রমিকের বেশিরভাগ বেকার হয়ে গেছেন।
ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্রমাবনতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে যশোর জেলা ট্রাক-ট্যাংকলরি মালিক সমিতির সভাপতি রেজাউল বিশ্বাস বলেন, মৌসুমে নওয়াপাড়া থেকে প্রতিদিন এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৭০০ ট্রাক পণ্য যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় এখন তা নেমে এসেছে ৫০০ থেকে ৭০০ ট্রাকে।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি ও যশোর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহজালাল বলেন, এখানকার বার্ষিক ব্যবসায়িক টার্নওভার ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা। তাই এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীসহ অন্যদের নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি কিছু ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য সংকুচিত হয়ে গেছে। ভয় পাওয়া ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি করতে চাইছেন না।
নওয়াপাড়া গ্রুপের ডেপুটি ম্যানেজার (অ্যাডমিন) সাইফুল ইসলাম বলেন, গত ১৮ জুলাই তাদের কার্যালয়ের সামনে বোমা হামলা হয়। প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘ ব্যবসায়িক ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা কখনো ঘটেনি। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে তাদের পক্ষে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
নওয়াপাড়া সার ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সম্পাদক শেখ আসাদুল্লাহ বলেন, বল প্রয়োগের ঘটনা ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ব্যবসার স্বাভাবিক পরিবেশ না থাকলে এ অঞ্চল তো বটেই, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিও হুমকির মুখে পড়বে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দাবস্থার কথা স্বীকার করেন ব্র্যাক ব্যাংক নওয়াপাড়া শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নুরুল্লাহও। আমার দেশকে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের লেনদেন আগের বছরের এ সময়ের তুলনায় কম।’
পূবালী ব্যাংক নওয়াপাড়া শাখার ব্যবস্থাপক ইকবাল হোসেন অবশ্য বলছেনÑক্রেতা কম, তাই পণ্যের বিক্রিও কম। তবে এর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জুলাই বিপ্লবে পটপরিবর্তনের পর কিছুদিন বিশৃঙ্খল অবস্থা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে এবং ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা বিধানে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করছে জেলা পুলিশ। যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল বাশার আমার দেশকে বলেন, নওয়াপাড়া গ্রুপের কার্যালয়ের সামনে বোমা হামলার ঘটনাটির রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশ কাজ করছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। দ্রুতই গোটা ঘটনা ব্যবসায়ীদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। এছাড়া তরিকুল হত্যাকাণ্ডে জড়িতদেরও শনাক্ত এবং তাদের মধ্যে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিন আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেছে।
এদিকে, নওয়াপাড়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য হ্রাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ যশোর-খুলনা মহাসড়কের নাজেহাল অবস্থা। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, এই পথ ব্যবহার করে নওয়াপাড়া থেকে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে ট্রাকযোগে পণ্য পাঠানো হয়। কিন্তু সড়কের অবস্থা এতটাই খারাপ যে, পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে অনেক। এ কারণে অনেক ব্যবসায়ী নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা বা নগরবাড়ী ঘাটে পণ্য এনে বিকল্প পথে তা উত্তরবঙ্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন। যশোর-খুলনা মহাসড়কের দুরবস্থা নিয়ে গত ৯ আগস্ট আমার দেশ-এ প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়া আমার দেশকে বলেন, মহাসড়কটিতে এখন সংস্কারকাজ চলছে। তবে চার লেনে উন্নীত করতে না পারলে ভোগান্তি দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পাশাপাশি অতিরিক্ত ওজনের লরি নিয়ন্ত্রণের ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে।