Image description

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে পাঁচ মাস আগে পতন ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের। গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে চলে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর তাঁর ব্যবহৃত সরকারি বাসভবন গণভবনকে জুলাই অভ্যুত্থানের জাদুঘর করার পরিকল্পনা করেছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। সে অনুযায়ী গণভবনে সাধারণের প্রবেশাধিকার সীমিত করা হয়েছে।

তবে সম্প্রতি গণভবনে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস। সেখানে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পাওয়া গেছে দেড় হাজার মার্কিন ডলার (ডলারের বর্তমান দরে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৮৪ হাজার টাকার বেশি) মূল্যের সোনার প্রলেপযুক্ত কলম। এটি জার্মানির মন্টব্ল্যাঙ্ক কোম্পানির প্রস্তুতকৃত। এই কোম্পানি কলম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের বিলাসবহুল পণ্য তৈরি করে।

কলম ছাড়াও গণভবনের ধ্বংসস্তূপে যুক্তরাজ্যের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল লেবার পার্টির নথি পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে শেখ হাসিনার ভাগনি ব্রিটিশ মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিক-সংশ্লিষ্ট নথিও। বিদেশি অতিথিদের দেওয়ার উপহারও পাওয়া গেছে, যার মধ্যে রয়েছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর দেওয়া উপহারও।

দ্য টাইমসের ওয়েবসাইটে গত রোববার প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, জুলাই অভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষ গণভবনে ঢুকে পড়ার পর তা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেই ধ্বংসস্তূপ এখনো বিদ্যমান। গণভবনের ধ্বংসস্তূপ আর ধুলোবালির মধ্যে দেড় হাজার ডলারের সোনার প্রলেপযুক্ত কলমের পাশেই পাওয়া গেছে কয়েকটি হীরা যাচাইয়ের সনদ। এর পাশে পড়ে ছিল কিছু কাগজ। সেখানে রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ ঠেকাতে ব্রিটিশ এক আইনজীবীর আইনি পরামর্শপত্র। কাগজগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে বিদেশি একটি ব্যাংকে হিসাব খোলার আবেদনপত্র। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডসংক্রান্ত

কিছু কূটনৈতিক পত্রও রয়েছে সেখানে।

দ্য টাইমসের সাংবাদিকেরা গত শনিবার গণভবনে ঢোকার সুযোগ পান। ১৮ একর জমির ওপর নির্মিত এই কমপ্লেক্সে একটি লেক রয়েছে। এই লেকেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাঝেমধ্যে বড়শি ফেলতেন মাছ ধরতে। গণভবনের ভেতরে সিঁড়ির ওপরে পাওয়া গেছে টিউলিপ সিদ্দিক-সংশ্লিষ্ট নথিপত্র। টিউলিপ যুক্তরাজ্যের হ্যামস্পিড অ্যান্ড কিলবার্ন থেকে পার্লামেন্ট সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর দল লেবার পার্টির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের দেওয়া একটি ধন্যবাদপত্র রয়েছে সেখানে। এ ছাড়া নিজ সংসদীয় এলাকায় মানুষের জীবনযাত্রার খরচ কমাতে টিউলিপ কী কী করেছেন, সে সম্পর্কিত ২০২২ সালের একটি প্রতিবেদনও রয়েছে।

দ্য টাইমস জানায়, গণ-অভ্যুত্থানের পর গণভবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল সেনাবাহিনী। তবে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে এটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এখানে যে জাদুঘরটি করার কাজ চলছে, তা আগামী আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের। বর্তমানে এই কমপ্লেক্সের নিরাপত্তায় আনসার বাহিনী নিয়োজিত রয়েছে।

গণভবনে প্রবেশ করতেই সোনালি রঙের কিছু চেয়ার পড়ে। কাছেই ছিল দাঁতের চিকিৎসার জন্য একটি চেয়ার, ম্যাসাজ নিতে চামড়ার আবরণের চেয়ার এবং একটি ট্রেডমিল। গণভবনের বাগানে ঘাসের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখা গেছে সাদাকালো একটি ছবি, যাতে বহু বছর আগে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর শিশুকন্যা শেখ হাসিনা ক্যামেরাবন্দী হয়েছিলেন।

গণভবনের প্রথম তলায়ই শেখ হাসিনার শয়নকক্ষ। সেটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও কিছু জিনিস অক্ষত রয়েছে। এই কক্ষেই একটি কোনায় ধুলোবালিতে মাখামাখি হয়ে রয়েছে হীরা যাচাইয়ে বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন প্রতিষ্ঠান জেমোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট অব আমেরিকার কয়েকটি সনদ। শয়নকক্ষের পাশেই শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত রান্নাঘর। সেখানে এমন কিছু জিনিস পাওয়া গেছে, যা বাংলাদেশে পাওয়াই যায় না। করিডরের মাথার দিকের কক্ষটি ব্যবহার করতেন টিউলিপ সিদ্দিকের ভাই রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। সেখানে ববির জাতিসংঘের বিজনেস কার্ড পাওয়া গেছে। আর পাওয়া গেছে তাঁর মোবাইল ফোন বিল।

গণ-অভ্যুত্থানে গণভবনে লুটের পর অনেকেই অনেক জিনিস ফেরত দিয়ে গেছেন। সেগুলো একটি জায়গায় মজুত করা হয়েছে। ওই মজুতের মধ্যে দেশি-বিদেশি অতিথিদের দেওয়া উপহার রয়েছে। তার মধ্যে পাওয়া গেছে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর দেওয়া একটি স্কার্ফ, যা তিনি ২০২১ সালে বাংলাদেশ সফরের সময় শেখ হাসিনাকে দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তৎকালীন ফরাসি প্রধানমন্ত্রী জ্যঁ কটেখ। তিনি শেখ হাসিনাকে একটি সোনার স্যুভেনির দিয়েছিলেন। সেটাও রয়েছে ওই স্তূপে। মজুতে পাওয়া গেছে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর দেওয়া চীনা টি-সেটও। যুক্তরাজ্যের সাবেক মন্ত্রী অলোক শর্মা বাংলাদেশ সফর করেছিলেন ২০২১ সালে। তিনি যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে উপহার দিয়েছিলেন চায়ের পেয়ালা।

শেখ হাসিনার সাবেক এক উপদেষ্টার মালিকানাধীন ডেইলি অবজারভারের দেওয়া একটি ছবিও পাওয়া গেছে গণভবনে। সেই ছবিতে শেখ হাসিনার সঙ্গে ক্যামেরাবন্দী হয়েছিলেন তাঁর বোন শেখ রেহানা ও ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক। একই কক্ষে ধুলোবালির মধ্যে পড়ে ছিল আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ ইংরেজি দৈনিক ‘আওয়ার টাইম’-এর একটি কপি। ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত ওই কপির প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল ‘পিএম শেখ হাসিনা ইজ অন দ্য লিস্ট অব পাওয়ারফুল উইমেন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড (বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা)’।