
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বুক ও পেট পুলিশের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যায় ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। জুলাই বিপ্লবের প্রতীক শহীদ আবু সাঈদকে প্রকাশ্যে পাখির মতো মেরে ফেলায় ফুঁসে উঠেছিল সারা দেশ।
গত বছরের ৩০ জুলাই ময়নাতদন্তের ভুয়া প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য তৎকালীন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাজিবুল ইসলামকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) নেতারা ক্রমাগত হুমকি দিতে থাকেন। তাতেও কাজ না হওয়ায় দেওয়া হয় সপরিবারে বিদেশ ভ্রমণের প্রলোভন। তবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শহীদ আবু সাঈদের সঠিক ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন করেছেন বলে সাক্ষ্য দেন ডা. রাজিবুল ইসলাম।
গতকাল রোববার বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ গতকাল রোববার দেওয়া সাক্ষীর জবানবন্দিতে রাজিবুল ইসলাম আবু সাঈদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিয়ে শেখ হাসিনা ও তার দলের নানা জালিয়াতির চেষ্টার বর্ণনা দেন।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সপ্তম দিনে সাক্ষ্য গ্রহণে ডা. রাজিবুল ইসলাম বলেন, ‘শহীদ আবু সাঈদের গলা থেকে ঊরু পর্যন্ত ছিল ছররা গুলির আঘাত। কিন্তু মৃত্যুর পর ৩০ জুলাই ময়নাতদন্তের ভুয়া প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিলেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজিবুল ইসলাম।
জবানবন্দিতে রাজিবুল ইসলাম বলেন, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আমি শহীদ আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত করি। আবু সাঈদের শরীরে অনেকগুলো পিলেট পাওয়া যায়। পিলেট বিদ্ধ হয়ে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের কারণে মৃত্যু হয়েছে বলে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে উল্লেখ করি। তবে মতামতসহ আমার করা রিপোর্ট তাজহাট থানার তদন্ত কর্মকর্তাকে দিতে গেলে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট গ্রহণ না করে নতুন করে রিপোর্ট লিখতে বলে। এভাবে তিনবার আমার রিপোর্ট গ্রহণ করা হয়নি। এভাবে চাপ দিয়ে মোট চারবার প্রতিবেদন পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
ট্রাইব্যুনালে রাজিবুল ইসলাম বলেন, ‘মাথায় আঘাত, বিভিন্ন ক্ষত এবং সাঈদের শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত জমাট বাঁধার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বলা হয়, এসব আঘাতের কারণে ‘শক’ এবং ‘রক্তক্ষরণে’ আবু সাঈদের মৃত্যু হয়। তারপরও তা লিখিনি। প্রচণ্ড হুমকি ও চাপে পড়ে সর্বশেষ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন জমা দিই। একই প্রতিবেদন দ্বিতীয়বারও ভাষাগত পরিবর্তন করে পেশ করি। কিন্তু সেটাও গ্রহণ করা হয়নি। এভাবে আমি তৃতীয় রিপোর্টও পেশ করি। চতুর্থবার রিপোর্ট দেওয়ার আগে ৩০ জুলাই রংপুর মেডিকেল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের (মাহফুজুর রহমান) রুমে আমাকে ডেকে নেয়।’
সে সময় ডিজিএফআই, সিটিএসবি, পুলিশের ডিসি ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি (রংপুর) ডাক্তার চন্দন উপস্থিত ছিলেন জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘ওই সময় রুমের বাইরে অবস্থান করছিলেন ডিজিএফআই, এনএসআই ও পুলিশের অন্য কর্মকর্তারা। তারা আমাকে বুলেট ইনজুরির পরিবর্তে হেড ইনজুরি উল্লেখ করে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করার চাপ দেন। তাদের মন মতো রিপোর্ট না হলে আমার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলেও হুমকি দেন। আমাকে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড ঘুরে আসার প্রলোভন দেখায় তারা। তখন আমি বলি, ‘আমার পাসপোর্ট নেই।’ পরে তারা আমাকে দুই সপ্তাহের জন্য কক্সবাজার ঘুরে আসতে বলেন, ‘আমি বলি, আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার দৃশ্য সারা বিশ্বে লাইভে সম্প্রচারিত হয়েছে। আমি যদি হেড ইনজুরিতে মৃত্যু হয়েছে বলে রিপোর্ট দিই, তাহলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের মানুষ চিকিৎসক সমাজকে ঘৃণার চোখে দেখবে।’
রাজিবুল ইসলাম বলেন, “এরপর স্বাচিপের সভাপতি চন্দন আমাকে বলেন, ‘আবু সাঈদের লাশ নিয়ে ব্যবসা চলছে। নেত্রী (শেখ হাসিনা) এ ব্যাপারে কনসার্ন আছেন। পুলিশ যেভাবে রিপোর্ট চায় সেভাবে রিপোর্ট দিয়ে দাও। তোমার বিষয়টা আমরা দেখব।’ এত কিছুর পরেও আমি আমার অবস্থান থেকে সরে আসিনি। আমি কোনো হেড ইনজুরি পাইনি। সর্বশেষ চতুর্থবার আমার প্রদত্ত রিপোর্ট ইনজুরির বর্ণনা ঠিক করলেও গানশট ইনজুরির কথা উল্লেখ করিনি। পিলিট ইনজুরিসহ অন্যান্য বর্ণনা দিয়ে রিপোর্ট পেশ করি। তারপর তারা সেটি নিয়ে যায়।”
কিন্তু এত হুমকি-ধমকির পরেও আমি আমার জায়গা থেকে সরে যাইনি। সর্বশেষ দেওয়া পোস্টমর্টেম রিপোর্টে আমি আবু সাঈদের শরীরে পিলেট ইনজুরির বর্ণনা দিই। তবে রিপোর্টে গানশট শব্দটা লিখিনি। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন চিকিৎসক রাজিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার স্ত্রী ও দুটি সন্তান আছে। হাসিনা সরকার থাকলে আজ আমার কী হতো? তারপরও আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্য প্রতিবেদন দিয়েছি। আমি আবু সাঈদ হত্যার নির্দেশদাতা শেখ হাসিনাসহ জড়িতদের বিচার ও শাস্তি চাই।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে গতকাল শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এসএইচ তামিম, বিএম সুলতান মাহমুদ ও ফারুক আহাম্মদ প্রমুখ। একসময় অপর প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে এই মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে জেরায় ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।
এদিকে এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এদিন সাক্ষ্য গ্রহণের সময় কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন। এখন পর্যন্ত এই মামলায় ১৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছে।
গতকাল আরো সাক্ষ্য দেন কুষ্টিয়ার সাংবাদিক শরিফুল ইসলাম। তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আহত হন। আন্দোলনে তার হাত-কব্জি ঝাঁজরা হয়ে যায়। ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত মেডিকেল রিপোর্টে দেখা যায় এখনো বহু গুলি তার হাতের ভেতর রয়ে গেছে। জবানবন্দিতে তিনি কুষ্টিয়া গণহত্যায় আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু, যুবলীগ নেতা আতা, আজগর আলী, সদর খান, গৌরব চাকী, বাবুল, রাজনসহ জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের ফাঁসির দাবি জানান।
গুমের মামলায় হাসিনাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ২৬ অক্টোবর
আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সংঘটিত গুম-খুনসহ নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২৬ অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল রোববার এ দিন ধার্য করেন। ট্রাইব্যুনালের বাকি দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এ মামলার ১১ আসামির মধ্যে এখন পর্যন্ত চারজনের নাম প্রকাশ করেছে প্রসিকিউশন। শেখ হাসিনা, জিয়াউল ছাড়াও অন্যরা হলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। বর্তমানে এ মামলায় জিয়াউল আহসান গ্রেপ্তার রয়েছেন। তাকে গতকাল ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
শাপলা গণহত্যায় তৎকালীন আইজিপিসহ চারজনকে জিজ্ঞাসার অনুমতি ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে গণহত্যা-নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক আইজিপি একেএম শহিদুল হকসহ গ্রেপ্তার চার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান ও পুলিশের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোল্যা নজরুল ইসলাম। তাদের যেকোনো দিন জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়।
এ সংক্রান্ত বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের করা আবেদনের শুনানি নিয়ে গতকাল ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এই আদেশ দেন।