Image description
 
 
আশি’র দুই কবির মিল-অমিলে পথ চলা
কবি হাসান হাফিজ ও কবি আবদুল হাই শিকদার—দুজনই বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্যজগতের গুরুত্বপূর্ণ কবি, তবে তাঁদের সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি, কাব্যচর্চার শৈলী ও রাজনৈতিক চেতনাতে রয়েছে কিছু মিল এবং উল্লেখযোগ্য অমিল।
দুই জনই আশির দশকের প্রায় একই সময় কাব্য চর্চা ও সাংবাদিকতা শুরু করেছেন। দৈনিক বাংলা-বিচিত্রায় কাজ করেছেন দুই জনই। দুই জনই এখন বাংলাদেশের দুই শীর্ষ পত্রিকা কালের কণ্ঠ ও যুগান্তরের সম্পাদক। একজন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি অন্যজন ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি।
দু’জনই দীর্ঘদিন ধরে বাংলা সাহিত্যে নিবেদিত থেকেছেন। কবিতাই তাঁদের প্রধান পরিচয়। তারা কবিতার ভাষা ও বোধে স্বতন্ত্র রুচি ও গভীরতা তৈরি করেছেন। উভয় কবির লেখায় সময়ের সংকট, সমাজের টানাপড়েন এবং মানুষের ভেতরকার অন্তর্দর্শন চিত্রিত হয়েছে। তাঁরা বাস্তবতা থেকে দূরে সরে লেখেন না। দু’জনই সাহিত্য প্রতিষ্ঠান বা তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর বাইরে দাঁড়িয়ে নিজেদের কণ্ঠ তৈরি করেছেন, কখনো কখনো প্রচলিত সাহিত্যধারার সমালোচকও হয়েছেন।
উভয়েই কবিতাকে আত্মপ্রকাশ ও সমাজ-চেতনার মাধ্যম হিসেবে দেখেন। তাঁদের কবিতায় সময়ের অনিবার্য প্রশ্ন, সমাজের সংকট ও নৈতিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটে। দুই কবিই সময়ের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেন না। তাঁরা দুজনেই কাব্যভাষায় স্বকীয়তা বজায় রেখেছেন। নকল বা পশ্চিমা অনুকরণ না করে বাংলা ভাষার নিজস্ব ছন্দ ও আঙ্গিককে গুরুত্ব দিয়েছেন। হাসান হাফিজ যেমন সাংবাদিকতা ও সাহিত্য সম্পাদনায় যুক্ত, তেমনি আবদুল হাই শিকদারও বহুদিন ধরে গণমাধ্যম ও সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত।
নান্দনিকতা বনাম প্রতিবাদী উচ্চারণ
তবে হাসান হাফিজ যেখানে নান্দনিকতা ও শৈল্পিক সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দেন। প্রেম, আত্মজিজ্ঞাসা, নিঃসঙ্গতা, ব্যক্তিগত বোধ যেখানে তার বেশি সেখানে আবদুল হাই শিকদার প্রতিবাদ, রাজনৈতিক দায়, জাতীয় চেতনা, সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে উচ্চারণকে প্রত্যক্ষ করেছেন তার কবিতায়। হাসান হাফিজের কাব্য ভাষা ও শৈলীতে রয়েছে ঘন রূপক, বিমূর্ততা, কাব্যিক আবহ—অনেকটা রোমান্টিক ধারার প্রকাশ দেখা যায়। অন্য দিকে আবদুল হাই শিকদার সরল, সরাসরি, রাজনৈতিক ভাষ্যসমৃদ্ধ—কখনো প্রবন্ধধর্মী কাব্যভাষা ও শৈলি পছন্দ করেন। কিন্তু শিল্প সৌকর্যকে কোন সময় বাদ দিয়ে নয়।
হাসান হাফিজ সচেতন হলেও অতটা প্রকাশ্য রাজনৈতিক হন না, অন্যদিকে শিকদার সরাসরি ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও অপশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে রাখডাকের ধার ধারেন না। হাসান হাফিজ সাহিত্যিক প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় আর আবদুল হাই শিকদারকে বাস্তব সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় দেখা যায় বেশি। হাসান হাফিজ কবি ও কবিতা নিয়ে গবেষণা করেন। কবি, সাংস্কৃতিক সংগঠক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক লেখক শিকদার ইতিহাস ঐতিহ্যের শেকড় অনুসন্ধানের চেষ্টা করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা সাহিত্যে অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘ সময়। কিন্তু তার জনপ্রিয়তার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিটিভির শেকড় অনুসন্ধানের প্রামাণ্য অনুষ্ঠানগুলো।
হাসান হাফিজ মূলত একজন নান্দনিক চেতনার কবি, যাঁর কবিতায় দেখা যায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, শিল্পচিন্তা ও মননবিশ্লেষণের এক সৌন্দর্য-সচেতন প্রকাশ। অন্যদিকে, আবদুল হাই শিকদার একজন ঐতিহ্য সচেতন ও প্রতিবাদী কবি, যিনি কবিতাকে কেবল শিল্প নয়, বরং রাজনৈতিক চেতনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে দ্বিধা করেন না।
তাঁদের মধ্যে একদিকে যেমন আছে সাহিত্যিক নিষ্ঠা ও স্বকীয়তার মিল, অন্যদিকে রয়েছে আঙ্গিক, ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পার্থক্য। হাসান হাফিজ কবিতাকে চেতনাগত ও নান্দনিক অনুসন্ধানের একটি রূপ হিসেবে দেখেন। তাঁর কবিতা মননশীল পাঠকের জন্য। অন্যদিকে, আবদুল হাই শিকদার কবিতাকে সরাসরি রাজনৈতিক-সামাজিক যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। তাঁদের এই পার্থক্য বাংলা কবিতার বহুরৈখিকতাকেই আরও সমৃদ্ধ করেছে।
এই দুই ভিন্ন প্রকৃতির কবি— ভিন্ন ধারা ও দর্শনে বিশ্বাসী, কিন্তু উভয়ের লক্ষ্য একটাই: সত্যের প্রকাশ এবং মানুষের মুক্তি।
বাংলা কবিতার ভুবনে হাসান হাফিজ ও আবদুল হাই শিকদার দু’জনেই সুপ্রতিষ্ঠিত নাম, তবে তাঁদের কাব্যচর্চার ভেতর রয়েছে ভিন্ন স্বর ও ভিন্ন লক্ষ্য। একজনের কবিতা আত্মবীক্ষণের দিগন্তে যাত্রা করে, অন্যজনের কবিতা প্রতিবাদের শাণিত অস্ত্র হয়ে উঠে দাঁড়ায়। এই দুইধারার বিশ্লেষণ আমাদের সময়ের কবিতাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।
হাসান হাফিজের কবিতা যেন একটি একান্ত ব্যক্তিগত অন্বেষণ, যেখানে হৃদয়ের গভীরতাকে রূপক ও চিত্রকল্পে মূর্ত করা হয়। আর আবদুল হাই শিকদারের কবিতা সমষ্টির স্বর, যা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক দলিত কণ্ঠস্বর হয়ে কথা বলে।
তাঁদের কাব্যচর্চা—দুই বিপরীত মেরু হলেও—আধুনিক বাংলা কবিতাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা ও বিস্তার।
হাসান হাফিজ: প্রেম, সময়, অস্তিত্ব ও নিঃসঙ্গতার কবি
হাসান হাফিজের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কাব্যিক সৌন্দর্য, বিমূর্ত প্রতীক, এবং চিত্রকল্পের জাদুকরী ব্যবহার। তাঁর কবিতায় ভাষা হয়ে ওঠে নিজেই একটি বাস্তবতা। প্রেম, নিঃসঙ্গতা, সময় ও অস্তিত্বের সংকট—এই সব বিষয় তাঁর কবিতায় ঘন আবহে এসেছে। আত্মানুসন্ধান ও দার্শনিক প্রশ্নমালা তাঁর কাব্যচিন্তার কেন্দ্র। তাঁর কবিতায় বহুসময় এক ধরনের অলৌকিক বাস্তবতার আবেশ দেখা যায়, যা পাঠককে ধীরে ধীরে আবিষ্ট করে।
কখনো তাঁর কবিতা অতিমাত্রায় বিমূর্ত হওয়ায় সাধারণ পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। সমাজ বা রাষ্ট্র বিষয়ে সরাসরি বক্তব্য তার তুলনামূলকভাবে কম। তিনি লিখেছেন:
"সময়ের ধুলোমাখা পৃষ্ঠায় আমি লিখি / নিঃশব্দ ভালোবাসার উপাখ্যান / যেখানে তোমার নামটাই ছিলো প্রশ্নবোধক চিহ্ন" — এটি প্রেম ও বেদনার ভেতরে থেকেও কবিতার গূঢ় অভিব্যক্তিকে তুলে ধরে।
‘নিঃসঙ্গতার ভাষা’য় তিনি লিখেছেন- "নিঃসঙ্গতা একটি ভাষা / কেউ বোঝে না / শুধু রাতজাগা দেয়াল জানে..." এখানে রয়েছে- একাকিত্ব, আত্মবিচ্ছিন্নতা, অনুভূতির নিঃশব্দ বিস্তার। এটি তাঁর অন্যতম বিখ্যাত কবিতা, যেখানে নিঃসঙ্গতা এক ব্যক্তিগত মানসিক ভূগোল হয়ে ওঠে। এর ভাষা নির্মোহ, তবুও আবেগে ছায়াময়।
ভালোবাসা একটি গোপন বিপ্লব- এ তার উচ্চারণ- "তোমাকে ভালোবাসা মানে / নিজের ভেতরের রাষ্ট্র ভেঙে ফেলা..." এখানে রয়েছে- প্রেম ও বিপ্লবের অন্তর্গত সংযোগ। ভালোবাসাকে এখানে তিনি একটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ক্রিয়া হিসেবে উপস্থাপন করেছেন—যা সমাজের সকল নিপীড়নের বিপরীতে দাঁড়ায়।
আমি একটি স্থবির যন্ত্রণার নাম- এ হাসান হাফিজ লিখেছেন- "ঘড়ির কাঁটা থেমে গেলেও / আমার যন্ত্রণার সময় চলে যায় না..." এখানে মূর্ত হয়েছে অস্তিত্বের সংকট, সময়ের অসাড়তা। এই কবিতায় হাসান হাফিজ যেন সময় ও আত্মার গভীর চূর্ণ বিচূর্ণতার দলিল লিখেছেন। কবিতাটি আবেগপ্রবণ ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে গভীর।
তৃতীয় চোখের অন্ধকার- এ আত্মদর্শন, সচেতনতার ভার তার মূল থিম। তিনি দর্শন ও বাস্তবতার দ্বন্দ্বকে কবিতায় তুলে ধরেছেন অসাধারণ কাব্যভাষায়। এখানে প্রতীকীতা অত্যন্ত শক্তিশালী।
কোনো এক ভবিষ্যৎ তোমার নামে লেখা ছিল কবিতায় তার উচ্চারণ ছিল- "হয়তো একটা ইতিহাস লেখা হতো / যদি তুমি থেমে যেতে / আমার দিকের বাতাসে..."
হারিয়ে যাওয়া সম্ভাবনা, নিয়তি ও সম্পর্ক এখানে তার মূল বিষয়। কবিতাটি সময়ের ভাঙা আয়নায় সম্পর্কের সম্ভাব্য পথ রচনার এক অনুপম দৃষ্টান্ত।
হাসান হাফিজের সেরা কবিতাগুলো মূলত এক অন্তর্মুখী যাত্রা, যেখানে পাঠক নিজের ভেতরের নিঃসঙ্গতা, প্রেম, ক্ষয় ও অস্তিত্বকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। তাঁর কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা যেন শব্দের নীরব সংগীত।
হাসান হাফিজের একবারেই সাম্প্রতিক একটি কবিতা- “মুগ্ধ জেগে আছি”। বাংলা কবিতায় প্রতিবাদ, মানবিকতা ও রাজনৈতিক চেতনার এক অনন্য সংমিশ্রণ ঘটেছে হাসান হাফিজের এই কবিতায়। তাঁর কবিতাটি সাম্প্রতিক ইতিহাসের এক করুণ অথচ গৌরবময় অধ্যায়কে ধারণ করে—যেখানে মুগ্ধ নামের এক তরুণ আন্দোলনকারীর আত্মত্যাগ সংগ্রামী প্রজন্মের প্রতীক হয়ে উঠেছে। কবিতাটি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-যুব আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত।
এতে ফ্যাসিবাদ বিরোধি আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারানো মুগ্ধ হয়ে ওঠেন শহীদ তরুণ প্রজন্মের প্রতিচ্ছবি। তাঁর শেষ উচ্চারণ—“পানি লাগবে, পানি?”—আজ আন্দোলনের বেদনাবাহী প্রতীক।
এটি শুধু একটি শোকগাথা নয়; এটি প্রতিরোধ, প্রেরণা ও পুনর্জাগরণের কবিতা। এই কবিতায় হাসান হাফিজের ভাষা সংক্ষিপ্ত, দৃঢ় ও হৃদয়বিদারক—যা পাঠককে কাঁদায়, আবার সাহসী করে তোলে। এই কবিতার শক্তি সরল অথচ গভীর উচ্চারণ; যেখানে ব্যক্তিগত বেদনা পরিণত হয়েছে জাতীয় চেতনার অংশে।
নিঃসঙ্গতার ভাষা, ভালোবাসা একটি গোপন বিপ্লব, শব্দের একাকীত্ব, আলোকের বিষণ্নতা, আমি সময় ছুঁয়ে দেখি- হাসান হাফিজের উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।
প্রতিবাদ ও জাতিসত্তা অন্বেষণের কবি হাই শিকদার
আবদুল হাই শিকদারের কাব্য সরাসরি নিপীড়ন, সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, বৈষম্য ও রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তাঁর কবিতায় রয়েছে পথশিশু, শ্রমিক, কৃষক, শহীদ ছাত্র—এদের জীবনসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। তার কাব্যভাষা সহজ, কিন্তু তীক্ষ্ণ ও বিশ্লেষণাত্মক। জাতীয় ইতিহাস, সাংস্কৃতিক নিপীড়ন ও রাজনৈতিক দমন তাঁর কাব্যের প্রধান উপজীব্য। তিনি ইতিহাসকে পুনরায় কবিতায় ব্যাখ্যা করেন।
অনেক সময় সাহিত্যিক আঙ্গিকের জায়গায় কখনো কখনো অতিরিক্ত রাজনৈতিক প্রত্যক্ষতা কাব্যিকতা কিছুটা কমিয়ে দিতে পারে। কিন্তু শিকদারের ক্ষেতে এটি ততটা দেখা যায় না। যেমন তিনি লিখেছেন- "যে কণ্ঠে গান ছিল, আজ স্লোগান হয়ে ওঠে / যে চোখে স্বপ্ন ছিল, আজ জ্বলন্ত বুলেট"
— এখানেই দেখা যায় তাঁর কবিতার রাজনৈতিক প্রতিবাদ ও রূপকের শাণিত ব্যবহার।
আবদুল হাই শিকদার বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্য ও সংস্কৃতি আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি, যাঁর কবিতায় প্রতিবাদ, জাতিসত্তা, সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা উঠে আসে সাহসী ভাষায়। তিনি শুধু কবি নন, একজন সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক এবং চিন্তাশীল লেখক—যাঁর কাব্যচর্চা হয়ে উঠেছে একটি বিপ্লবী আত্মজিজ্ঞাসার অংশ।
আবদুল হাই শিকদারের সেরা সৃষ্টির একটি- এই দেশ তোমার নয়। এতে তিনি লিখেছেন- "তুমি যাকে ইতিহাস বলো / আমি তাকে বলি বিকৃত মুখোশ..."
রাষ্ট্রের নিপীড়ন, মালিকানার প্রশ্ন, শোষিত জনগণের কণ্ঠ এখানে তার মূল বিষয় । এটি তাঁর সর্বাধিক আলোচিত রাজনৈতিক কবিতা। এখানে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতার একচেটিয়া দখলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে সরব প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন— "এই দেশ তোমার নয়, যারা বৃষ্টিতে ভিজে ঘরে ফেরে / যাদের কণ্ঠে স্লোগান জমে, তাদের / ঘাম-রক্ত-স্বপ্নের এই দেশ..."
‘ ফ্যাসিস্ট আস্তানা ভাঙো’তে শিকদার লিখেছেন—"যেখানে গান ছিল / সেখানে কামানের লাশ / কবিতা আর চুপ করে নেই..."
এখানে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কবিতাকে তিনি দেখেছেন অস্ত্র হিসেবে। কবিতাটি জুলাই ২৪ এর ছাত্র আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিতে নতুন তাৎপর্য পেয়েছে। এটি কেবল কবিতা নয়—একটি আন্দোলনের ভাষ্য।
মাইকহীন মানুষের পক্ষে কবিতায় হাই শিকদারের উচ্চারণ ছিল-"যাদের কোনো মাইক নেই / তাদের কান্নাই সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ..."
এই কবিতায় উঠে আসে পথশিশু, দিনমজুর, কুলি—যাঁদের ভাষা ও জীবন কখনো মূলধারায় আসে না। শিকদার তাঁদের পক্ষেই লেখেন।
জাতির কাঁধে বিষাক্ত ইতিহাস— এটি এক গভীর ঐতিহাসিক আত্মসমালোচনা। এখানে মুক্তিযুদ্ধ, গণআন্দোলন এবং ইতিহাসকে দখল করে রাখার ক্ষমতার রাজনীতিকে তিনি চ্যালেঞ্জ জানান।
শিকদার লিখেছেন- "প্রতিদিন একটি করে সত্য খুন হয় / পত্রিকার শিরোনাম হয় না..." — (সত্যের মৃত্যু)… "এই নগরী জেগে ওঠে, যখন কারফিউ নামে / এই কবিতা জেগে ওঠে, যখন মানুষ ঘুমায় না..." — (আন্দোলনের আগুন)
এখানে ইতিহাসের বিকৃতি ও বিভ্রান্তিকে আবদুল হাই শিকদার লক্ষবস্তু করেছেন।
ছিন্নমাথা জাতির কাব্য— এ নেতৃত্বহীন জাতির সংকট তুলে ধরেছেন কবি। তার এই কবিতাটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী রাজনৈতিক রূপক, যেখানে জাতিকে উপস্থাপন করা হয়েছে একটি ছিন্নমস্তক দেহ হিসেবে—নেতৃত্ববিহীন, দিকহীন, সংগ্রামী।
আবদুল হাই শিকদারের কবিতা কেবল সাহিত্যিক অনুভব নয়—এটি রাজনৈতিক বাস্তবতার ভাষ্য। তাঁর সেরা কবিতাগুলো সরাসরি গণমানুষের কথা বলে, আর তাই এগুলো আমাদের সময়ের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য দলিল।
মাইকহীন মানুষের পক্ষে, ফ্যাসিস্ট আস্তানা ভাঙো, তৃতীয় বিশ্বে জন্মেছি বলে, এই দেশ তোমার নয়, জাতির কাঁধে বিষাক্ত ইতিহাস আবদুল হাই শিকদারের উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি।