Image description

র‌্যাবে কর্মরত থাকাকালে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান কীভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে লিখেছেন সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়া।

তিনি তার ফেসবুক পোস্টে ‘বিজিবি, র‌্যাব, এসএসএফ ও আনসার নিয়ে আমার যত অভিজ্ঞতা’ বিষয়ে জিয়াউল আহসানকে নিয়ে লেখেন: ‘যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দিত, তা ছিল র‍্যাব-এ প্রেষণে থাকা আমাদের অফিসারদের দ্বারা সাধারণ নাগরিক, রাজনৈতিক কর্মী বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের অপহরণ ও হত্যা।

তরুণ, ক্যারিয়ারমুখী অফিসারদের র‍্যাবে পাঠানো হতো, সেখানে কিছুদিন কাজ করে তারা এমন এক চরিত্র নিয়ে ফিরত, যেন তারা পেশাদার খুনি। একই প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছিল জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও), নন-কমিশন্ড অফিসার (এনসিও) এবং সৈনিকদের মধ্যেও। আমি সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই চাইছিলাম তাদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে আনা হোক। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানালে তিনি আমার কথায় সম্মতিসূচক ইঙ্গিত দিলেন, এমনকি বললেন জাতীয় রক্ষীবাহিনী থেকেও র‍্যাব খারাপ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বাস্তবে রূপ নেয়নি।

কয়েক দিন পর আমি কর্নেল (পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও ডিজি এসএসএফ) মুজিবকে—যিনি তখন র‍্যাবের এডিজি (ADG) ছিলেন—ডেকে বলি যেন তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল (এখন মেজর জেনারেল) জিয়াউল আহসানকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন এবং আর যেন কোনো ‘ক্রসফায়ার’ না ঘটে। কর্নেল মুজিব এ ব্যাপারে আমাকে কথা দেন এবং বিদায় নেওয়ার সময় তাকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হয়। পরের কয়েক দিন পত্র-পত্রিকা লক্ষ করলাম, নতুন কোনো ক্রসফায়ারের খবর নেই—এতে মানসিকভাবে কিছুটা স্বস্তি পেলাম।

এরপর কর্নেল মুজিব একাধিকবার আমাকে এসে জানিয়েছিলেন, সত্যিই ক্রসফায়ারের ঘটনা বন্ধ হয়েছে। কিছুদিন পর আমি বুঝতে পারি ঘটনা ঠিকই ঘটছে কিন্তু সেগুলোর খবর চাপা দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে যখন কর্নেল মুজিব র‍্যাব ছেড়ে অন্যত্র বদলি হয়ে যান, আর কর্নেল জিয়াউল আহসানÑযিনি আগে র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখার দায়িত্বে ছিলেনÑনতুন ডিজি বেনজীর আসার সঙ্গে সঙ্গে এডিজি র‍্যাব হিসেবে দায়িত্ব নেন।

এরপর আর্মি নিরাপত্তা ইউনিট (ASU) সূত্রে খবর পাই যে, কর্নেল জিয়া নিজের আবাসিক টাওয়ারে একজন গার্ড রেখেছেন, বাসায় অস্ত্র রাখছেন এবং পুরো ফ্ল্যাটে সিসিটিভি বসিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে বলা হয় গার্ড সরিয়ে নিতে, ক্যামেরাগুলো খুলে ফেলতে, বাসায় অস্ত্র রাখা থেকে বিরত থাকতে এবং অফিসিয়াল কোয়ার্টারে যে সামরিক নিয়মকানুন আছে, সেগুলো মেনে চলতে।

পরবর্তীকালে তার আচরণ আরো উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে। ডাইরেক্টর মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স (DMI) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জগলুল তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন কিন্তু তাতে কর্নেল জিয়া কোনো কর্ণপাত করেননি। পরে আর্মি নিরাপত্তা ইউনিটের (ASU) কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজল তাকে আলাপের জন্য ডাকেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজল আমাকে জানান, জিয়ার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মনে হয়েছে যেন সে এমন একজনের সঙ্গে কথা বলছে যার মস্তিষ্ক পাথর বা ইটের টুকরো দিয়ে ঠাসা—বোঝানোর কোনো উপায় নেই।’

সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ইকবাল করিমের লেখা থেকে আরো জানা যায়, ঢাকা সেনানিবাসের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জিয়াউল আহসানকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিলেন তিনি। তিনি এও লেখেন, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল তারিক সিদ্দিক, প্রধানমন্ত্রী মিলিটারি সেক্রেটারি ও অ্যাসিসট্যান্ট মিলিটারি সেক্রেটারির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগে জিয়াউল আহসান তার নির্দেশকে তখন চ্যালেঞ্জ করা শুরু করেন।

কে এই মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসান?

জিয়াউলের চাকরিজীবন সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি সেনাবাহিনীর ২৪তম লং কোর্সের কর্মকর্তা। পরিচিতি নম্বর বিএ-৪০৬০। ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশে যেকোনো বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, আয়নাঘর, টেলিমনিটরিং ইত্যাদি সব অপরাধের চিহ্নিত অন্যতম প্রধান ব্যক্তি এই জিয়াউল আহসান। তারিক সিদ্দিকই তার প্রধান বস। তিনিই তাকে ‘মনস্টার’ বা দানব বানিয়েছেন।

জিয়াউল আহসান ২০০৯ সালে এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত র‌্যাব-২ এর টুআইসি হিসেবে যোগদান করেন। লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে র‌্যাব সদর দপ্তরে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হন। ওই বছরের মে মাসে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে গণহত্যায় তিনি র‌্যাবের অভিযান পরিচালনা করেন। ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনাও তার নির্দেশনায় ঘটে। ২০১৫ সালে তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। তাকে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইর পরিচালক (প্রশিক্ষণ) পদে পদায়ন করা হয়। এক বছর পর তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) পরিচালক করা হয়। ২০২১ সালে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতির পর তিনি এনটিএমসির মহাপরিচালক হন।

জিয়াউল আহসানের গুম সংক্রান্ত অপরাধ সম্পর্কে জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে গুম কমিশনের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, কমিশন নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে নয়, সামগ্রিক গুমের তদন্ত করছে। গুম কমিশনের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে জানা গেছে, কীভাবে গুম করা হতো, গুমের পর খুন করা হতো এবং লোমহর্ষক নির্যাতন করা হতো। গুমে ‘সুপিরিয়র কমান্ড’ ছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি তারেক সিদ্দিকের মাধ্যমে গুমের কিংবা খুন করার নির্দেশগুলো দিতেন। কমিশনের রিপোর্টে বিভিন্ন কেস স্টাডি তুলে ধরা হয়েছে। সাদা পোশাকে এক বাহিনীর সদস্যরা গুম করত, প্রচার করা হতো অন্য বাহিনীর নাম। এক বাহিনীর সাদা পোশাকধারীরা তুলে নিয়ে আসত টার্গেট মানুষটিকে, হস্তান্তর করত অন্য বাহিনীর হাতে। যত গুম হয়েছে তার মধ্যে জিয়াউল আহসানের টিমই বেশি করেছে। গুমের শিকার হওয়া মানুষদের মধ্যে জিয়াউল আহসান ও তার টিম হত্যাই করেছে এক হাজার ৩০ জনকে। এজন্য বুড়িগঙ্গার পোস্তগোলা ঘাট নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। কত মানুষকে তিনি গুম করেছেন এ পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়।

বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান শেখ হাসিনার পনেরো বছরের শাসনকালে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। শেখ হাসিনা ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল তারিক সিদ্দিক বড় বড় যত অপকর্ম করিয়েছেন, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন জিয়াউল আহসান। অপহরণ, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ফোনে আড়ি পেতে কল রেকর্ড করা সবকিছুতেই তার সংশ্লিষ্টতা ছিল। জুলাই-আগস্টের গণহত্যায়ও অভিযুক্ত হয়েছেন এই কর্মকর্তা। সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়ার (আইকেবি) লেখাতেও জিয়াউল আহসানের অপরাধের বর্ণনা রয়েছে। জিয়াউল আহসান তাকে মেরে ফেলতে পারেন এমন তথ্যে তিনি আতঙ্কিত ছিলেন। একদিন সেনাপ্রধানের কার্যালয়ে বোমা আতঙ্কও দেখা দেয়।