Image description
রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে

ময়মনসিংহ জেলা পুলিশে চরম অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। গত পাঁচ মাসে কেবল কোতোয়ালি মডেল থানায়ই পাঁচবার ওসি বদলি, প্রত্যাহার ও সংযুক্তির ঘটনা ঘটেছে। এমন কর্মকাণ্ডে পুলিশ সুপার (এসপি) কাজী আখতার উল আলমসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে কোতোয়ালি মডেল থানার বর্তমান ওসি মুহাম্মদ শিবিরুল ইসলামের বিরুদ্ধেও উঠেছে গুরুতর অভিযোগ। তাদের বিভিন্ন বিতর্কিত ভূমিকা জেলায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

গত ৪-৫ মে একযোগে ছয় থানার ওসিকে বদলির আদেশ জারি করা হয়, যার মধ্যে ছিলেন কোতোয়ালি মডেল থানার তৎকালীন ওসি সফিকুল ইসলাম খান শফিক। বিষয়টিকে রাজনৈতিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল হিসেবে দেখা হয়। এর মাত্র দুই সপ্তাহ পর ১৮-১৯ মে ভালুকা মডেল থানার পরিদর্শক মিজানুর রহমানকে কোতোয়ালি মডেল থানার নতুন ওসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু নোয়াখালীর সেনবাগ থানায় গুরুতর মামলার প্রধান আসামি হওয়ার তথ্য যাচাই না করেই এ নিয়োগ দেওয়া হয়। মাত্র তিনদিনের মাথায় তাকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়, যা এসপির চরম ব্যর্থতা প্রমাণ করে। এরপর ৪ জুন মুহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে ওসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মাত্র ১৯ দিন পর তাকেও হঠাৎ প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনসে পাঠানো হয়। সর্বশেষ গফরগাঁও থানার ওসি মুহাম্মদ শিবিরুল ইসলামকে কোতোয়ালি মডেল থানায় বদলি করে আনা হয়। এভাবে ঘন ঘন ওসি বদলের কারণে থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম ও অপরাধ দমন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ঘটনা ময়মনসিংহের নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করছে।

বিতর্কিত এসপি ও ওসির রাজনৈতিক যোগসূত্র

এসপি কাজী আখতার উল আলম এবং ওসি মুহাম্মদ শিবিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে সুবিধাভোগী হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এসপি কাজী আখতার ওরফে রেজার গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানায়। তিনি ছাত্রাবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ করতেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বারবার পদোন্নতি পান। ২০১৩ সালে সিনিয়র স্কেলে পদোন্নতি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ২০১৫ সালে সিনিয়র এএসপি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ৬৫তম মিলিটারি ওরিয়েন্টেশন ট্রেনিংয়ে অংশ নেন। ২০২০ সালের জুনে তিনি ঢাকা জেলার পিবিআই থেকে চাঁদপুর পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার হিসেবে বদলি হন। ২০২২ সালের জুনে তিনি পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পেয়ে পিবিআইয়ের বিশেষ পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেন।

এসপি কাজী আখতার ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুদ্ধাচার পুরস্কার লাভ করেন, যা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে দেখা হয়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তিনি ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব নেন।

অভিযোগের বিষয়ে এসপি কাজী আখতার বলেন, ‘আমি ছাত্রলীগ করতাম কি না তা বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শুদ্ধাচার পুরস্কার পাইনি।’

তবে আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ২৬ জুন কর্মক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠার জন্য কাজী আখতার উল আলমকে ২০২১-২২ অর্থবছরের শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। এরপর একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর পুলিশ সদর দপ্তরের হল অব ইন্টিগ্রিটিতে তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন তার হাতে এ পুরস্কার তুলে দেন। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পিবিআইপ্রধান বনজ কুমার মজুমদারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ওসি মুহাম্মদ শিবিরুল ইসলাম

মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার বাসিন্দা শিবিরুল ইসলাম, যার ডাকনাম অজয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে এসআই হিসেবে পুলিশে যোগ দেন। শিবিরুল ইসলাম আওয়ামী পুলিশ হওয়ায় ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি আইজিপিস এক্সেম্পলারি গুড সার্ভিস ব্যাজ লাভ করেন। এই ব্যাজ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের বিতর্কিত ‘রাতের ভোটের’ কারিগর হিসেবে পরিচিত তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীর নির্দেশে যারা কাজ করেন, এমন ৫১৪ পুলিশ কর্মকর্তাকে দেওয়া হয়েছিল। শিবিরুল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় নিয়মিত বৈঠকে যোগ দিতেন।

গফরগাঁওয়ের ওসি থাকাকালে এক যুবলীগ নেতাকে ‘জুলাইযোদ্ধা’ হিসেবে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য কার্ড তুলে দিয়ে তিনি সমালোচিত হন, যা তার রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের প্রমাণ হিসেবে গণ্য হয়। গফরগাঁওয়ের সাবেক এমপি ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের প্রিয়ভাজন ছিলেন শিবিরুল। গফরগাঁওয়ে বিএনপি-জামায়াত নির্মূলে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন তিনি। ২০১৪ সালে তিনি ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানায় সেকেন্ড অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তখন বিএনপি-জামায়াতের নিতাকর্মীদের ঘরে থাকতে দিতেন না বলে সর্বমহলে আলোচিত। সম্প্রতি পুলিশের সাবেক এক এসআইয়ের স্ত্রী আফরোজা ইয়াসমিন এসপি বরাবর শিবিরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন।

অভিযোগে আফরোজা উল্লেখ করেন, তার স্বামী নাজিম উদ্দিন ২০২১ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে মারা যান। কিন্তু বর্তমানে ওই নারীর ওপর শিবিরুল অপবাদ দিয়ে বলেন, স্বামী নাজিমকে আফরোজা ইয়াসমিন হত্যা করেছেন। অথচ তার স্বামী করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে মারা গেছেন, যার মৃত্যু সনদও আছে। ‍শুধু তাই নয়, গত ২৮ জুলাই ময়মনসিংহ মহানগর যুবলীগ নেতা তুহিনকে জেলগেট থেকে গ্রেপ্তারের পর মধ্যরাতে দফারফার মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে শিবিরুলের বিরুদ্ধে।

ওসি শিবিরুলের ব্যাপারে এসপি কাজী আখতার বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর শিবিরুল আইজিপিস এক্সেম্পলারি গুড সার্ভিস ব্যাজ পেয়েছিলেন কি না তা তিনি জানেন না। তাছাড়া আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী যদি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় সে ব্যাপারে এসপি অফিসে জানানোর জন্য বলেন তিনি।

রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার চেষ্টা

এসপি কাজী আখতারের বিরুদ্ধে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি আমিনুল ইসলাম শামীম এবং সাবেক এমপি মহিবুর রহমান শান্তকে হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন গুরুতর মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার পাঁয়তারার অভিযোগ উঠেছে। ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডের থানার পূর্ববর্তী ওসি সফিকুল ইসলাম খান শফিক ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি আমিনুল হক শামীম ও ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি মোহিত উর রহমান শান্তর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছিলেন। তারপর এসপি কাজী আখতার দায়িত্ব নেওয়ার পর ওসি শফিককে বদলি করে দেন। এরপর তিনি আদালত থেকে পুরোনো সব চার্জশিট ফেরত এনে শামীম ও শান্তর নাম বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

এছাড়া ছাত্রলীগ নেতা শাওন হত্যা (২০১৮), রাসেল হত্যা (২০১৯) এবং শেখ আজাদ হত্যা (২০১৮) মামলায় জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি আমিনুল হক শামীম এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি মোহিত উর রহমান শান্তর বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট জমা দেওয়া হলেও এসপি কাজী আখতার এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন বলে জানা গেছে। শুধু তাই নয়, গত জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী ময়মনসিংহে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ও হামলা চালিয়েছিল, তারা প্রকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের গ্রেপ্তার কো হচ্ছে না।

ময়মনসিংহে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও নাগরিক সমাজের উদ্বেগ

কয়েক মাস ধরে ময়মনসিংহের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রকাশ্যে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী এবং জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সমন্বয়কদের হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের বিরুদ্ধে বদরুল আমীন নামে কথিত আওয়ামী সাংবাদিক ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ‘সমন্বয়কদের ঝুলিয়ে হত্যার’ আহ্বান জানান। অথচ পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার না করে উল্টো সহযোগিতা করছে।

জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স ময়মনসিংহ জেলার আহ্বায়ক আল নূর মোহাম্মদ আয়াশ বলেন, গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা বদরুলকে কোতোয়ালি থানা প্রাঙ্গণে আটক করে ওসিকে খবর দেওয়া হলেও ওসি শিবিরুল তাকে গ্রেপ্তার না করে ছেড়ে দেন।

আয়াশ নিজে ফোন দিয়ে ওসিকে বলছিলেন বদরুলের হুমকির ব্যাপারে থানায় তার অভিযোগ দেওয়া আছে। তাকে আটক করুন। এরপরও আটক করেননি ওসি শিবিরুল। বদরুল আমীন গত ১৭ বছর পুলিশের মাধ্যমে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন।

ময়মনসিংহের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দুর্বল ভূমিকার কারণে অপরাধীরা সুযোগ নিচ্ছে, যার কারণে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত জেলায় ৪৫টি খুন, ২০০টি ছিনতাই ও ডাকাতি এবং দুই শতাধিক অপহরণ ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।

এ ব্যাপারে ময়মনসিংহের রেঞ্জ ডিআইজি মোহাম্মদ আতাউল কিবরিয়ার সরকারি মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।