Image description

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পাঠ করা জুলাই ঘোষণাপত্রে শেখ হাসিনার গত সাড়ে পনেরো বছরের শাসনকে 'জনবিরোধী, স্বৈরাচারী, মানবাধিকারবিরোধী, যা বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদী, মাফিয়া ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে' বলে দাবি করা হয়েছে। সরকারের এ দাবির সমালোচনা করেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। একই সঙ্গে ড. ইউনূসের সরকারের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অস্বীকার করা ও এড়িয়ে যাওয়ার কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি। এসব আচরণকে 'লজ্জার' বলে আখ্যায়িত করেন বিশিষ্ট এই সাংবাদিক।

আওয়ামী লীগের সমালোচনার নামে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এড়িয়ে যাওয়া ও বদলানোর সুযোগ নেই বলে মনে করেন মাহফুজ আনাম। ১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, অনুপ্রেরণা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার নাম জুলাই ঘোষণাপত্রে একবারও উল্লেখ না করায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শেখ হাসিনার সরকারের শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, "এই অগ্রগতি কি 'ব্যর্থ রাষ্ট্র'র চিহ্ন? এখন কি আমরা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছি না?"

তিনি বলেন, 'শেখ হাসিনার (গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী) ১৫ বছরের বেশি শাসনামলের যত ইচ্ছা সমালোচনা করুন এবং তার জন্য যথেষ্ট তথ্যভিত্তিক প্রমাণ রয়েছে—গত ৭ই আগস্ট দ্য ডেইলি স্টারেও এ বিষয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। কিন্তু, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কোনোভাবেই হেয় করবেন না। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সর্বোচ্চ গর্বের উৎস, এর জন্য এ দেশের মানুষ সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করেছে।'

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে গত ৫ই আগস্ট ঢাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এর বিভিন্ন দিকের সমালোচনা করে মাহফুজ আনাম বলেন, ঘোষণাপত্রে উল্লেখ নেই আমাদের ভাষা আন্দোলন, নেই পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পরপরই ছাত্র হত্যার ঘটনা এবং 'একুশে ফেব্রুয়ারির' জন্ম কথা। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের কথাও সেখানে নেই, যে নির্বাচন আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জনগণের পক্ষে কথা বলার বৈধতা দিয়েছিল।

তিনি বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের কোথাও মুক্তিবাহিনীর কথাও নেই। অথচ, তারা আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়ের নায়ক। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন ছিল মুক্তিবাহিনীর গঠন ও প্রসারের কেন্দ্র। এমনকি আলোচনাই নেই আমাদের নারীদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচার ধর্ষণের কথা নিয়ে!

মাহফুজ আনাম বলেন, আমাদের সবচেয়ে বিস্মিত করেছে, এই ঘোষণাপত্রে তরুণদের আলাদা কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তরুণরাই আমাদের নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ দিয়েছে। একাধিক সম্মেলনে ড. ইউনূস তরুণদের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন এবং কেবল বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে কোনো আলাপ নেই ঘোষণাপত্রে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, নারীদের জন্য কিছুই নেই। অথচ, তারা আমাদের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ। তারপরও তাদের কষ্ট বা অবস্থান নিয়ে একটি বাক্যও নেই এই ঘোষণাপত্রে।

'জুলাই ডিক্লেয়ারেশন: হোয়ার ইজ দ্য রোডম্যাপ ফর আউয়ার জার্নি' শিরোনামে প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয়তে মাহফুজ আনাম এসব কথা বলেন। তার লেখা এ উপসম্পাদকীয় গত ৮ই আগস্ট ডেইলি স্টারের ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত হয়। লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর এটিকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানামুখী আলোচনা চলছে পাঠকদের মধ্যে। লেখাটি ইংরেজি পত্রিকার পাঠকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে।

ওই কলামে মাহফুজ আনাম লেখেন, ''জুলাই ঘোষণাপত্রের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে শেখ হাসিনার শাসনকে বলা হয়েছে 'জনবিরোধী, স্বৈরাচারী, মানবাধিকারবিরোধী, যা বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদী, মাফিয়া ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করেছে এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।' এই অভিযোগগুলো মেনে নেওয়ার যথেষ্ট ভিত্তি আছে। কিন্তু বাংলাদেশ কী একটি 'ব্যর্থ রাষ্ট্র'? বাকি সব বাদ দিন, আমরা কি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছি না? ব্যবসায়ীদের অনুরোধ সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকারই এই প্রক্রিয়া পেছাতে দেয়নি, কারণ আমরা প্রস্তুত। তাহলে? এই অগ্রগতি কী 'ব্যর্থ রাষ্ট্র'র চিহ্ন? এখন কী আমরা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছি না?"

মাহফুজ আনাম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ঘোষণাপত্রটি পাঠ করলেন এবং যেটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেটা কেবল আমাদের ইতিহাসের 'পছন্দসই অংশ বাছাই করে নেওয়া'র উদাহরণ। যা আসলে টুকলিফাই (নকল করা) বলে মনে করেন মাহফুজ আনাম।

তিনি লেখেন, 'আরও লজ্জার বিষয়, সরকারপ্রধান হিসেবে ড. ইউনূস যে ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেছেন, সেখানে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের সেই কালোরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার কোনো উল্লেখ নেই। মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ কী না, তা নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এটা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, লাখো নিরপরাধ নারী, পুরুষ ও শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল কেবল বাঙালি ও পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক হওয়ার অপরাধে।'

তিনি উল্লেখ করেন, "এমনকি আলোচনাই নেই আমাদের নারীদের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচার ধর্ষণের কথা নিয়ে! সেই নয় মাসে জাতিগত নিধন ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রনীতির অংশ ছিল। সম্প্রতি প্রকাশিত স্কট কার্নি ও জেসন মিকলিয়ানের লেখা 'দ্য ভরটেক্স: অ্যা ট্রু স্টোরি অব হিস্ট্রিস ডেডলিয়েস্ট স্টর্ম, অ্যান আনস্পিকেবল ওয়ার, অ্যান্ড লিবারেশন'-এ ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত প্রমাণগুলোর অমূল্য দলিল যোগ হয়েছে।"