Image description

দেশ অর্থনৈতিক সংকটে থাকলেও বিলাসবহুল প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের জন্য উঠছে। ‘বাংলাদেশ ফিল্ম সিটি (পর্যায়-২)’ নামের ৫০৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প আগামী রবিবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদনের জন্য তোলা হচ্ছে।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা শুরুতে প্রকল্পটি ছোট পরিসরে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তা আমলে নেয়নি। এমনকি শেখ হাসিনার সরকারের মেয়াদকালে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে তোলা হলেও অনুমোদন পায়নি। তখন প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৩৭৯ কোটি টাকা। এবার সেটি বাড়িয়ে ৫০৬ কোটি টাকা করা হয়েছে।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে তিন বছর ছয় মাস মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে। গাজীপুরের কবিরপুরে ১০৫ একর জমিতে নির্মাণ করা হবে এই ফিল্ম সিটির দ্বিতীয় ধাপ।

থাকবে আধুনিক শুটিং স্পট, পোস্ট-প্রোডাকশন স্টুডিও, ফ্লোর, কেবল কার, ঝর্না, কটেজ, ইকোপার্কসহ পর্যটকদের জন্য নানা বিনোদনের ব্যবস্থা। প্রকল্পটির আগে নাম ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিল্ম সিটি। ফিল্ম সিটি থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ গেলেও তাঁর ভাস্কর্য নির্মাণে সাত কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে পাঁচতারা হোটেল ও কনভেনশন সেন্টার নির্মাণের প্রস্তাব থাকলেও পরিকল্পনা উপদেষ্টা গত ২১ এপ্রিল মন্তব্য করেন, ‘প্রথম পর্যায়ে আরো ছোট আকারে, যেমন—হোটেল ও কনভেনশন হল বাদ দিয়ে প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে।

বিষয়টি সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে বিবেচনায় আনার পরামর্শ দেওয়া হয়।’ তবে চূড়ান্ত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) এই পরামর্শ প্রতিফলিত হয়নি।

২০১৫ থেকে ২০১৮ মেয়াদে প্রকল্পের প্রথম ধাপ বাস্তবায়ন করা হয় ১৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে। তবে এর সুফল ছিল সীমিত। নির্মিত অবকাঠামোর ঘাটতি ও আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে নির্মাতারা এখনো চলচ্চিত্রের পোস্ট-প্রোডাকশন, কালার গ্রেডিংসহ বিভিন্ন কাজের জন্য বিদেশে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। রাজস্ব আয়েও বড় ধরনের অগ্রগতি হয়নি।

চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও থাইল্যান্ডে সফল ফিল্ম সিটি মূলত বেসরকারি বিনিয়োগ ও যৌথ উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে সরকারি খরচে বিশাল বিনিয়োগের উদাহরণ কম। তাঁদের মতে, অবকাঠামোর চেয়ে প্রশিক্ষণ, প্রণোদনা ও কর সুবিধা চলচ্চিত্রশিল্পে বেশি কার্যকর।

প্রকল্পের আওতায় নির্মিত হবে দুটি অত্যাধুনিক শুটিং স্টুডিও ও ফ্লোর (তিন হাজার ২০০ বর্গমিটার), তিনতলা পোস্ট-প্রোডাকশন স্টুডিও (তিন হাজার বর্গমিটার), প্রশাসনিক ভবন, অভ্যন্তরীণ সড়ক (৫০ হাজার বর্গমিটার), স্যুয়ারেজ লাইন (১০ হাজার মিটার), ফায়ার সেফটি সিস্টেম, কেবল কার, ঝুলন্ত ব্রিজ, ঝর্না, কটেজ, বাসস্ট্যান্ড ও ইকোপার্ক।

প্রযুক্তি সংগ্রহে রাখা হয়েছে চারটি ডিজিটাল মুভি ক্যামেরা, চার সেট মাস্টার প্রাইম লেন্স (প্রতিটি সেটে আটটি লেন্স), ৮৫১টি বিভিন্ন ধরনের লাইট, ডিজিটাল এডিটিং মেশিন ও সাউন্ড ইকুইপমেন্ট।

প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এই অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি প্রস্তুত হলে নির্মাতারা দেশেই শুটিং ও টেকনিক্যাল কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারবেন। এতে দেশীয় শিল্পে গতি আসবে বলে দাবি করা হয়েছে।

তবে পরিকল্পনা কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ৫০৬ কোটি টাকা বিনিয়োগে কতটা রিটার্ন আসবে, তা স্পষ্ট নয়। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এ ধরনের বিলাসী ব্যয় কতটা যুক্তিসংগত, সেই প্রশ্ন থেকে যায়। তাঁর মতে, বড় বাজেটের প্রকল্পে ক্রয়সংক্রান্ত স্বচ্ছতার ঘাটতি ও সময়সীমা অতিক্রমের ঝুঁকি থাকে। পর্যটন উপযোগী অংশগুলো (যেমনকটেজ, ইকোপার্ক) রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষণেও প্রকল্প থেকে লাভ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নেট প্রেজেন্ট ভ্যালু (এনপিভি) মাত্র ৩১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, বেনিফিট কস্ট রেশিও (বিসিআর) ১.০৭ এবং ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন (আইআরআর) ১৪ শতাংশ, যা এত বড় প্রকল্পের জন্য খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়।

পরিকল্পনা কমিশনের ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, এই মুহূর্তে এত বড় ব্যয়ে এই প্রকল্প নেওয়ার প্রয়োজন নেই। পরিকল্পনা উপদেষ্টাও বলেছিলেন, ছোট আকারে শুরু করা হোক। কিন্তু মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য পক্ষের চাপেই প্রকল্পটি অনুমোদনের দিকে এগোচ্ছে।

প্রকল্পের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) কাইয়ুম আরা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা ব্যয় কমাতে বলেছিলাম। তবে তারা নানা যুক্তি দেখিয়ে ব্যয় কমায়নি। আর কিভাবে প্রকল্পে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য এখনো রাখা হয়েছে, সেটা আমি দেখব।