Image description

গ্রাহককে ‘স্মার্ট’ মিটার দেওয়ার কথা বলে আসলে ‘আনস্মার্ট’ মিটার আর ‘স্মার্ট’ দুর্নীতির মহোৎসবের উদাহরণ তৈরি করা হয়েছে। স্মার্ট বিদ্যুৎ সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল মুখে মুখে। বাস্তবে গুদামে জমেছে লাখ লাখ মিটার, আর ফাইলপত্রে মিলছে না শত শত কোটি টাকার হদিস। ২০২১ সালে অনুমোদন পাওয়া ৭৪৮ কোটি টাকার ‘স্মার্ট প্রি-পেইড মিটারিং’ প্রকল্পটি ছিল ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার অন্যতম বড় উদ্যোগ।

তিন বছরে কাজ এগোয়নি আশানুরূপ, বরং অডিট বলছে, সরঞ্জাম কেনা, চুক্তি লঙ্ঘন, ট্যাক্স ফাঁকি ও অকার্যকর ব্যয়ে প্রকল্পে অনিয়ম হয়েছে অন্তত ৫৪১ কোটি টাকার। ঘরে পৌঁছেনি মিটার, কিন্তু হিসাব ছাড়া খরচে প্রকল্পটি এখন দুর্নীতির মডেল।

সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই চিত্র। সংস্থাটি বলছে, এই প্রকল্পের পেছনে সরকারের উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা আনা।

অথচ এখন তা পরিণত হয়েছে অনিয়ম, দুর্নীতি ও গাফিলতির এক বড় উদাহরণে।

মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিজিএ) দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক অডিট প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মাত্র ১২টি আপত্তিতেই প্রকল্পটিতে ৫৪১ কোটি ১৭ লাখ টাকার আর্থিক অনিয়ম ও অসংগতি রয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, কিন্তু ২০২৫ সাল পার হতে চললেও প্রায় অর্ধেক মিটার এখনো বসানো হয়নি। অথচ আর্থিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, প্রকল্পের বরাদ্দ অর্থের বড় অংশ এরই মধ্যে খরচ হয়ে গেছে।

অনেক যন্ত্রাংশ বছরের পর বছর গুদামে পড়ে থাকায় এরই মধ্যে কিছু নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব মিটার ব্যবহার উপযোগিতা হারাতে শুরু করেছে।

এখানেই শেষ নয়, প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরু থেকেই কেনাকাটায় অস্পষ্টতা ছিল। অডিট প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ১৬১ কোটি টাকার সরঞ্জাম ডিপিপি অনুযায়ী নির্ধারিত মানের ছিল না। অথচ এসব যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পুরো বিল পেয়েছে, কোনো প্রশ্ন না করে।

পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, এসব নিম্নমানের যন্ত্রাংশের কারণে অনেক মিটার কাজ করছে না, কিছু গ্রাহকের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রিচার্জ থাকার পরও, আবার কিছু ক্ষেত্রে মিটার সম্পূর্ণ লক হয়ে যাচ্ছে।

সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয়, ডিপিপিতে না থাকা খাতেও প্রায় ৪৫ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। সফটওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণ, অতিরিক্ত সহায়ক সেবা ও সরবরাহ সম্পর্কিত খাতে এই ব্যয় হয়েছে, যার কোনো অনুমোদন ছিল না। এসব ব্যয়ের পেছনে নেই বৈধ অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা, নেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র।

চুক্তির সময় যেসব সরঞ্জামের জন্য ৩৪ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছিল, সেগুলোর চূড়ান্ত মূল্য গিয়ে ঠেকেছে ৯৩ কোটি টাকায়। এমন অতিরিক্ত ব্যয়ের ক্ষেত্রে দর বিশ্লেষণ বা মূল্যায়ন প্রতিবেদন অডিটে পাওয়া যায়নি, যা ইঙ্গিত করে দরদাতার প্রস্তাব যাচাই না করেই বিল পরিশোধ করা হয়েছে। আর এভাবে প্রকল্পের একাধিক প্যাকেজে ব্যয় বেড়ে গেছে শতকোটি টাকা।

সরকারি প্রকল্পে আয়কর কর্তন বাধ্যতামূলক হলেও এই প্রকল্পের অন্তত পাঁচটি চুক্তিতে তা করা হয়নি। ফলে সরকারি কোষাগারে জমা পড়েনি তিন কোটি ৫০ লাখ টাকার রাজস্ব। অডিটে উল্লেখ করা হয়েছে, কর্তন না করার বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।

এদিকে ঠিকাদারদেরও চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ রয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না করলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো জরিমানা আরোপ করা হয়নি, বরং বিলম্বের পরও তাঁরা পুরো বিল পেয়ে গেছেন। সরকার নির্ধারিত ক্রয় নীতিমালায় বলা আছে, চুক্তি অনুযায়ী কাজ শেষ না হলে বিলম্ব-জরিমানা আরোপ করতে হবে, কিন্তু প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সেই পথে হাঁটেনি।

আরো হতবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো, প্রকল্পে প্রায় তিন কোটি টাকার খরচ দেখানো হয়েছে, যেগুলোর কোনো ব্যয় হিসাব বা ভাউচার অডিটে উপস্থাপন করা হয়নি। এককথায়, নথিপত্র ছাড়া খরচ। এমনকি এই খরচ কোথায়, কিভাবে, কার নামে করা হয়েছে, সেসব প্রশ্নের জবাবও পাওয়া যায়নি।

প্রকল্প পরিচালনায় দায়িত্বশীলতা দেখানো হয়নি প্রশাসনিক পর্যায়েও। প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) নিয়ম অনুযায়ী, বছরে অন্তত চারটি সভা হওয়ার কথা থাকলেও তিন বছরে মাত্র চারবার বৈঠক হয়েছে। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যেমনসময় বাড়ানো, খরচ পুনর্নির্ধারণ, চুক্তি সংশোধনএসবই পিএসসি সভা ছাড়াই কার্যত ফাইলে ফাইলেই হয়েছে।

এসব অডিট আপত্তি ও প্রকল্পের অব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মোজাহেরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, অযথাই তারা অডিট আপত্তি দিয়েছে, যেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। জবাব দিয়েছি, নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। গুদামে যেসব মিটার পড়ে আছে সেগুলো ধীরে ধীরে ব্যবহার করা হবে।

প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সেবার মান নিশ্চিত করা, তাতেও রয়েছে চরম ব্যর্থতা। বহু স্থানে বসানো মিটার ঠিকমতো কাজ করছে না। রিচার্জ করার পরও বিদ্যুৎ আসছে না, কারো মিটার বারবার লক হয়ে যাচ্ছে, আবার হেল্পলাইন বা টেকনিক্যাল সাপোর্ট না থাকায় গ্রাহকরা দিনের পর দিন ভোগান্তিতে পড়ছে। মাঠ পর্যায়ের কোনো কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণ টিম নেই, প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব প্রকট। এমনকি গ্রাহকদের অভিযোগ ব্যবস্থাপনারও কোনো কাঠামো গড়ে ওঠেনি।

সিজিএ বলছে, পুরো প্রকল্পে কার্যত কোনো ব্যয়েরই পূর্ণাঙ্গ হিসাব নেই। একদিকে যন্ত্র পড়ে নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে খরচের খাতায় কোটি কোটি টাকা উধাও। সরকারি অর্থে পরিচালিত এমন একটি প্রকল্পে যদি এই দুর্নীতির মহোৎসব হয়, তবে ভবিষ্যতের স্মার্ট বাংলাদেশ কতটা স্মার্ট হবে, সেই প্রশ্নও উঠছে জোরেশোরেই।

বিপিডিবির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, অনুমোদন ছাড়াই কোটি কোটি টাকা খরচ, চুক্তিভঙ্গের পরও ঠিকাদারকে ছাড়, এমনকি অকার্যকর যন্ত্রপাতি গ্রহণসবকিছুতেই ছিল প্রকল্প পরিচালকের নীরব সম্মতি বা প্রত্যক্ষ ভূমিকা। জবাবদিহির বদলে তিনি ছিলেন যেন লুটপাটের সাইলেন্ট পার্টনার। তাঁর দায়িত্বহীনতা পুরো প্রকল্পকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

সিংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে প্রি-পেইড মিটার চালুর লক্ষ্য ছিল ভোগান্তি কমানো, কিন্তু অনেক গ্রাহকের জন্য তা এখন অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রাহকদের অভিযোগ, বিদ্যুৎ বিতরণ কম্পানিগুলো পরিকল্পিতভাবে ব্যবহারের তুলনায় বেশি টাকা কেটে নিচ্ছে এবং জরুরি ব্যালান্সে অতিরিক্ত সুদ আদায় করছে। আগে যাঁদের মাসিক বিল হতো এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা, এখন তাঁদের দিতে হচ্ছে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। সর্বনিম্ন স্ল্যাবে ইউনিটপ্রতি ৫.২৬ টাকা হলেও সর্বোচ্চ স্ল্যাবে তা ১৪.৬১ টাকা। ফলে মাসের শুরুতে ১০০ ইউনিট কিনতে ৫০০ টাকা লাগলেও শেষে খরচ হয় এক হাজার ৫০০ টাকা। এদিকে প্রতি মাসেই মিটারভাড়া ও ডিমান্ড চার্জের নামে গ্রাহককে গুনতে হয় অতিরিক্ত অর্থ।