
রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে শীর্ষ ১১ গডফাদারের নিয়ন্ত্রণে আবার রমরমা হয়ে উঠেছে মাদক ব্যবসা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বারবার জোরালো অভিযানেও নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না মাদকের লেনদেন। আধিপত্য ধরে রাখতে এসব গডফাদারের সহযোগীরা বিপুল অস্ত্রের মজুদ করেছে। প্রায়ই বেধে যাচ্ছে সংঘর্ষ।
সূত্র জানায়, এর আগে গত এক বছরে একই কারণে এই মাদক কারবারিরা আরো পাঁচজন খুন করে। তাদের চাপাতির কোপে ও গুলিতে আহত হয় অর্ধশতাধিক লোক। এর মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে।
একাধিক মামলায় গ্রেপ্তারের পর জামিনে থাকা এসব শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী হলেন বুনিয়া সোহেল, চুয়া সেলিম, গালকাটা মনু, শাহ আলম, ইমতিয়াজ, পিচ্চি শামির, পিচ্চি রাজা, বড় রাজু, শাহজাদা, টুনটুন ও নাদিম।
এসব শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ৫ আগস্ট-পরবর্তী সরকার পরিবর্তনের পর যৌথ বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছিল। তবে সম্প্রতি তারা জামিনে বের হয়ে ফের আগের মতো ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা শুরু করে। এর মধ্যে বুনিয়া সোহেল ৩৬ মামলার আসামি। অন্যদের বিরুদ্ধেও ১০ থেকে ১২টি করে মাদকদ্রব্যসংক্রান্ত মামলা রয়েছে বলে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ বলছে, এর মধ্যে গত বছর ৩১ অক্টোবর সিলেটের কোতোয়ালি ও হবিগঞ্জের মাধবপুর এলাকা থেকে ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক কারবারি বুনিয়া সোহেলসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন. মোহাম্মদপুর থানাধীন আটকে পড়া পাকিস্তানিদের আবাসস্থল জেনেভা ক্যাম্পে দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা চলছে। এটি নিয়ন্ত্রণে না আসার ব্যর্থতা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের নিতে হবে।
পুলিশ বলছে, ক্যাম্পের অন্তত ৮০ শতাংশ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখন মাদকে জড়িয়ে পড়েছে। তবে ক্যাম্পের বাসিন্দারা বলছে, ক্যাম্পে দারিদ্র্যের পাশাপাশি রয়েছে বেকারত্ব। এর সুযোগ নিচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। এ ব্যাপারে মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, সম্প্রতি জেনেভা ক্যাম্পে তাঁরা গোয়েন্দা অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পেরেছেন, ক্যাম্পের ৮০ শতাংশ বাসিন্দা মাদক ব্যবসায় জড়িত। জামিনে থাকা ১১ জনের পাশাপাশি অন্তত ২০ জন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণ করছে ক্যাম্পের মাদক কারবার। তারা ক্যাম্পে থাকে না। শিশু ও কিশোরদের পাশাপাশি নারীদেরও ব্যবহার করে তারা ক্যাম্পে মাদক কারবার করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, জেনেভা ক্যাম্পে ছোট ছোট ঘর রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে পান-সিগারেট-চায়ের অনেক দোকান। এর বাইরে ভাসমান কিছু দোকান রয়েছে। সবই মাদক ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করে। অভিযান চালিয়ে গত এক বছরে শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজনসহ গ্রেপ্তার করা হয় কয়েক শ খুচরা ব্যবসায়ীকে। তাদের অনেকে জামিনে বেরিয়ে এসে আবার একই কাজ করছে।
পুলিশ বলছে, গত এক বছরে মোহাম্মদপুর থানায় যেসব মামলা হয়েছে, এর অন্তত ৬০ শতাংশ মামলা হয়েছে মাদককে কেন্দ্র করে। প্রতিদিন ক্যাম্প ও ক্যাম্পের আশপাশ এলাকা থেকে ১০ থেকে ১২ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পরও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
এক বছরে যারা নিহত : গত সোমবার ক্যাম্পে শাহ আলম নামে এক তরুণকে হত্যার আগে গত বছরের ৬ আগস্ট ক্যাম্পে গুলিতে মারা যান শাহেন শাহ নামের এক যুবক। একই দিনে গলায় গুলিবিদ্ধ হন শুভ নামের আরেক যুবক। পরে ১৭ আগস্ট আবারও সংঘর্ষ শুরু হয়, যা চলে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত। আরেক দফা বিরতির পর আবার ৩০ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংঘর্ষ হয়। ৪ সেপ্টেম্বর সোহেলের গুলিতে মারা যান অটোরিকশাচালক সাদ্দাম হোসেন সনু। আহত হন কুরাইশ। এরপর ২২ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে পরদিন সকাল পর্যন্ত চলে দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি ও গোলাগুলি। এর মধ্যে চুয়া সেলিমের স্ত্রী নাগিন বেগম এবং ২৩ সেপ্টেম্বর চারকো ইরফান গুলিবিদ্ধ হন। ২৪ সেপ্টেম্বর গুলিবিদ্ধ সাগর চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল ভোর ৫টার দিকে মারা যান। তিনি পেশায় কসাই ছিলেন। এর আগে ৩১ মে ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলিতে মারা যায় রাসেল নামের এক শিশু।
স্থানীয়া বলছে, কয়েক দিন ধরে ক্যাম্পে মাদক ব্যবসার দখল নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘাত ও অস্থিরতা চলছিল। গত বৃহস্পতিবার রাতে চুয়া সেলিমের আস্তানা পাক্কা ক্যাম্প এলাকায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের সামনে পরপর তিনটি ককটেল বিস্ফোরণে দুজন আহত হয়। স্থানীয়দের ভাষ্য, বুনিয়া সোহেল নিজে মোটরসাইকেলে করে এসে ককটেল ফাটিয়ে চলে যায়। এরপর থেকে ক্যাম্পের বিভিন্ন জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
সর্বশেষ গত রবিবার দুপুরেও এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণের আওয়াজ পায় ক্যাম্পবাসী। সোমবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত কয়েক দফায় ককটেল বিস্ফোরণের পর এলাকায় আতঙ্ক ছড়ায়। শীর্ষ মাদক কারবারি গালকাটা মুন ও ইমতিয়াজ গ্রুপের দ্বন্দ্বে ওই তরুণ খুন হয়।
ক্যাম্পের বাসিন্দারা যা বলছেন : ক্যাম্পের এক বাসিন্দা কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে এই ক্যাম্পের মাদক নিয়ন্ত্রণকারীদের মধ্যে বুনিয়া সোহেল ও তার লোকজন ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরে মাদক কারবার করছে। আর চুয়া সেলিমের এলাকা হচ্ছে এবি-ব্লক পাক্কা (পাকা) ক্যাম্প। এর বাইরে সৈয়দপুইরা বাবু গ্রুপ অপর একটি এলাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণ করছে।
গত কয়েক দিনে সরেজমিন ক্যাম্পে গিয়ে জানা যায়, বর্তমানে শীর্ষ মাদক কারবারিদের সাতটি গ্রুপ জেনেভা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের রয়েছে চার শতাধিক সদস্য।
যারা খুচরা বিক্রেতা : এসব শীর্ষ কারবারির গ্রুপে অন্তত ৬০ জনের বেশি সদস্য রয়েছে। ভাঙ্গারি আরজু, তোতে, কামরান, সাজু, আদিল ও ফাইজান একটি গ্রুপের সদস্য। বুনিয়া সোহেল, রানা, টুনটুন, কামাল, কালা, শহীদ ও রাব্বানি গ্রুপে রয়েছে ৫০ জনের বেশি সদস্য। এ ছাড়া গালকাটা মনু, শাহ আলম, ইমতিয়াজ, আকরাম চোরওয়া জানু, বিল্লু, সাবু, বাশির ও ইরফান গ্রুপে রয়েছে অন্তত ৫৫ জনের বেশি সদস্য। বাবু, সাদ্দাম, মনু, মোফিজ, সুমন, রাজু, নাদিম ও জাম্বু গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে অন্তত ৩৫ জন সদস্য রয়েছে।
সর্বশেষ সংঘর্ষ : পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র বলছে, মাদক নিয়ে বিরোধের জেরে গত সোমবার ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টর এলাকায় দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে দুই পক্ষ। এ সময় কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণের শব্দও শোনা যায়। এ সময় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে শাহ আলম নিহত হয়। এর আগে রবিবার রাতে ককটেল বিস্ফোরণে এক নারী আহত হন সেখানে।
এ বিষয়ে এসপিজিআরসি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এম শওকত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পে মাদকব্যবসা চলছে। এখানে বসবাসকারীরা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জীবিকার তাগিদে তারা ঝুঁকি নিয়ে মাদক কারবারের মতো অপরাধে জড়িয়েছে।’
পুলিশ জানায়, মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পসহ আশপাশের এলাকায় যৌথবাহিনীর বিশেষ অভিযানে এর আগে সাত দিনে ১৮০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ইবনে মিজান বলেন, ক্যাম্পের মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণে অনেক অভিযান চালানো হয়। পিচ্চি রাজা ও বুনিয়া সোহেল গ্রুপের দ্বন্দ্বে শাহ আলম নামে ওই যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ফয়সাল ও সেলিম নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে ফয়সালের কাছ থেকে একটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়।