
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মঙ্গলবার মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় একথা বলেন তিনি। আগামী নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে সরকার কাজ করছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। বিভিন্ন পেশা, শ্রেণি, সংস্থা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা এ মতবিনিময় সভায় অংশ নেন। প্রবাসীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্যে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা এখন নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রস্তুত। আমি ইতিমধ্যে নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেছি। এই নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে সরকার কাজ করছে। আশা করছি, এবার আপনাদের নতুন অভিজ্ঞতা হবে। আপনারা সবাই ভোটার হবেন, ভোট দেবেন। নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।’ সভায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় প্রধান উপদেষ্টা মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আপনারা অর্থনীতিতে মস্ত বড় অবদান রাখছেন। আপনাদের এই অবদানের স্বীকৃতি আমাদের দিতে হবে। আগামী নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।’ সভায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল উপস্থিত ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে চেষ্টা করেছি প্রবাসীদের সঙ্গে আলোচনা করতে, তাদের কথাগুলো শুনতে। আপনাদের অনেক অভিযোগ রয়েছে, অভিযোগ রয়েছে যা ন্যায্য। আমরা এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। জটিলতা কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ পাসপোর্ট সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে সরকার খুব দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে এবং সরকারি সকল সেবা প্রবাসীদের কাছে পৌঁছে দিতে ‘নাগরিক সেবা বাংলাদেশ’ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রবাসীদের জন্য একটি বিশেষ অ্যাপ তৈরির কাজ চলছে জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘যাতে করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত সকল প্রবাসী বাংলাদেশি এক প্ল্যাটফরমে কানেক্টেড (যুক্ত) থাকতে পারেন।’ বাংলাদেশের অর্থনীতি বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে প্রবাসীদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশের পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্বস্তির জায়গায় ফিরেছে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে আপনারা বড় অবদান রেখেছেন।’ সভায় মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের কয়েকটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে দূতাবাসে জনবল বাড়ানো, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েট প্লাস ভিসা, যারা অনিয়মিত হয়ে গেছেন তাদের নিয়মিতকরণ করা। এ সময় বাণিজ্য-শিল্প ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলে জানান প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানান।
মিয়ানমারে শান্তি মিশন পাবে মালয়েশিয়া এবং তার আঞ্চলিক মিত্ররা: এদিকে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য মিয়ানমারে একটি যৌথ প্রতিনিধিদল পাঠাবে মালয়েশিয়া এবং কয়েকটি আঞ্চলিক দেশ। কুয়ালালামপুর সফররত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মঙ্গলবার পুত্রজায়ায় এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ান প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এ ঘোষণা দেন। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ওই মিশন পাঠানো হতে পারে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এত বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গার আশ্রয়স্থল হিসেবে কক্সবাজার হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের তিন দিনের মালয়েশিয়া সফরের সূচনায় রোহিঙ্গাদের জন্য এ উদ্যোগ নেয়ার কথা জানান আনোয়ার ইব্রাহিম। রয়টার্সের রিপোর্ট মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠা অবশ্যই অগ্রাধিকার। একইসঙ্গে দুর্ভোগে থাকা শরণার্থী এবং ভূমিকম্প-দুর্গত মানুষের জন্য দ্রুত মানবিক সহযোগিতাও প্রয়োজন। বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছে মালয়েশিয়া। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বলেন, মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে মিয়ানমার মিশন সমন্বয় করবেন। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই মিশন পাঠানোর কথা রয়েছে। যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আনোয়ার ইব্রাহিম আরও বলেন, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভরণপোষণে বাংলাদেশের ওপর যে বোঝা চাপানো হয়েছে, তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বসবাস। তাদের বেশির ভাগই মুসলিম। জাতিসংঘ বলেছে, ক্রমবর্ধমান সংঘাত এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত সহিংসতার কারণে গত ১৮ মাসে সংখ্যালঘু এই গোষ্ঠীর প্রায় দেড় লাখ সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
মালয়েশিয়ার সঙ্গে ৫ সমঝোতা ও ৩ ‘নোট অব এক্সচেঞ্জ’ সই
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কুয়ালালামপুর সফরে প্রতিরক্ষা সহায়তা, জ্বালানি, কৌশলগত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে উচ্চশিক্ষা, কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণ এবং হালাল ইকোসিস্টেম নিয়ে ৩ ‘নোট অব এক্সচেঞ্জ’ সই হয়। তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে সোমবার থেকে কুয়ালালামপুর রয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুতিওন ইসমাইল বিমানবন্দরে প্রধান উপদেষ্টাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান।
পারদানা পুত্রায় আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা: ওদিকে, সফররত প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মালয়েশিয়ার পারদানা পুত্রা কমপ্লেক্সে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা জানানো হয়েছে। গতকাল সকাল ৯টায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী দাতুক সেরি আনোয়ার ইব্রাহিম তাকে অভ্যর্থনা জানান। এরপর বাজানো হয় দুই দেশের জাতীয় সংগীত। ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রথম মালয়েশিয়ার ব্যাটালিয়ন রয়্যাল রেঞ্জার রেজিমেন্টের তিনজন কর্মকর্তা ও ১০৩ জন সদস্যের একটি গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন, যার নেতৃত্ব দেন দেশটির মেজর আরিফুদ্দিন মোহাম্মদ ইউসুফ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী দাতুক সেরি ড. আহমাদ জাহিদ হামিদি ও দাতুক সেরি ফাদিল্লাহ ইউসুফ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি মোহাম্মদ হাসান, যোগাযোগমন্ত্রী দাতুক ফাহমি ফাজিল, বিদেশি কূটনীতিক এবং ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা। অনুষ্ঠান শেষে ড. ইউনূস স্মারক বইয়ে স্বাক্ষর করেন এবং পরে আনোয়ারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেন। দুই নেতা মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ সম্পর্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা করবেন, বিশেষ করে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শ্রম, শিক্ষা, পর্যটন ও প্রতিরক্ষা খাতসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেন।
সই হওয়া সমঝোতার বিস্তারিত: এদিকে, সই হওয়া সমঝোতার মধ্যে ছিল দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত এমওইউ, যা স্বাক্ষর করেন মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী দাতুক সেরি মোহাম্মদ খালেদ নরদিন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। এ ছাড়া তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), পেট্রোলিয়াম পণ্য এবং সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো সরবরাহ ও সহযোগিতার এমওইউ স্বাক্ষর করেন মালয়েশিয়ার অর্থমন্ত্রী (দ্বিতীয়) ও ভারপ্রাপ্ত অর্থনীতি মন্ত্রী দাতুক সেরি আমির হামজা আজিজান এবং বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতু, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং রেলপথ বিষয়ক উপদেষ্টা এম ফাওজুল কবির খান। অন্যান্য চুক্তির মধ্যে ছিল উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণ বিষয়ে নোট বিনিময়, যা স্বাক্ষর করেন মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক সেরি মোহাম্মদ হাসান, বাংলাদেশের ড. আসিফ নজরুল ও মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে। মোহাম্মদ হাসান উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী দাতুক সেরি ড. জাম্ব্রি আবদুল কাদিরের পক্ষ থেকে উচ্চশিক্ষা সহযোগিতার নোট বিনিময়ে স্বাক্ষর করেন। হালাল খাতে সহযোগিতা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের (ধর্মবিষয়ক) উপমন্ত্রী সিনেটর ড. জুলকিফলি হাসান এবং বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ হারুনের মধ্যে নোট বিনিময়ের মাধ্যমে। কৌশলগত গবেষণার ক্ষেত্রে, এমওইউ স্বাক্ষর হয় মালয়েশিয়ার ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (আইএসআইএস) এবং বাংলাদেশের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মধ্যে। ব্যবসায়িক খাতে, এমওইউ স্বাক্ষর হয় মাইমস সার্ভিসেস সফহ বিহাদ এবং বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিএমসিসিআই)-এর মধ্যে, এবং মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এনসিসিআইএম) এবং বাংলাদেশের ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)-এর মধ্যে।