Image description

রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একের পর এক উড়োজাহাজে ধরা পড়ছে যান্ত্রিক ত্রুটি। গত এক মাসে অন্তত ১৫টি উড়োজাহাজে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। এর মধ্যে  গত দু’দিনেই ত্রুটির কারণে বাতিল করা হয় অন্তত চারটি ফ্লাইট। কোনোটির ডানার ফ্ল্যাপে ত্রুটি, ইঞ্জিনে অতিরিক্ত কম্পন, কেবিনে অতিরিক্ত তাপ, টয়লেটের ফ্ল্যাশ নষ্ট, কোনোটির আবার ল্যান্ডিং গিয়ারের দরজা হচ্ছে না বন্ধ। এসব ত্রুটির কারণে একের পর এক ফ্লাইট বিলম্ব, বাতিল হওয়াসহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। এতে যাত্রী ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে। ইতালির রোমে ড্রিমলাইনারের ডানার ফ্ল্যাপ ত্রুটির কারণে তিন দিন ধরে ২৬২ জন যাত্রী ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। ফ্লাইট বিলম্বের কারণে যাত্রীদের হোটেলে রাখা হয়েছে। অন্য কোনো ফ্লাইটের ব্যবস্থা না করায় হোটেলেই অবস্থান করতে হচ্ছে তাদের। অনেক যাত্রীই জরুরি প্রয়োজনে দেশে আসার কথা থাকলেও হোটেল রুমে তারা অলস সময় কাটিয়ে ক্ষোভ ঝাড়ছেন বিমান বাংলাদেশের ওপর। আর রোম বিমান বন্দরে অতিরিক্ত অবস্থানের কারণে বিমানকে গুনতে হবে বাড়তি টাকাও। এর ফলে শিডিউল বিপর্যয়ের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংস্থা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো গেলেও বিমানের নিরাপত্তার মান ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, যেভাবে ঘন ঘন বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি দেখা দিচ্ছে উড়োজাহাজে এটি বড় কোনো দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। বিমানের প্রকৌশল বিভাগের দায়সারা কাজের জন্যও এমনটি হতে পারে। সময়মতো রক্ষণাবেক্ষণ না করা, পার্টসের কার্যকারিতা আগেই শেষ হয়ে যাওয়া, বেশি পুরোনো উড়োজাহাজ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনার কারণে এমনটি হতে পারে। তাই বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া এসব ত্রুটির কারণে যেভাবে যাত্রী ভোগান্তি বাড়ছে বিমানের ভাবমূর্তি রক্ষা করাই এখন চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

বিমানের বহরে মোট ২১টি উড়োজাহাজ রয়েছে, যার মধ্যে ১৬টি বোয়িং। এগুলোর মধ্যে ছয়টি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার, চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর এবং ছয়টি ন্যারোবডি বোয়িং ৭৩৭। এ ছাড়া স্বল্প দূরত্বের রুটে চলাচলের জন্য বহরে পাঁচটি ড্যাশ-৮০০ উড়োজাহাজ রয়েছে। তবে এসব উড়োজাহাজের বড় একটি অংশ প্রায়ই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিকল হয়ে থাকে। এতে উড়োজাহাজের সংকট দেখা দিয়েছে। কোনো উড়োজাহাজ মেরামতের পর উড্ডয়ন করছে আবার কোনোটি গ্রাউন্ডেড অবস্থায় রয়েছে। এর ফলে নিয়মিত শিডিউল বিপর্যয় ও ফ্লাইট বাতিলের ঘটনা ঘটছে। গতকালও বাতিল হয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঢাকা-কুয়েত ও ঢাকা-চট্টগ্রাম-দুবাই রুটের দু’টি ফ্লাইট। বিমান সূত্র জানিয়েছে, গতকাল ঢাকা-কুয়েত ও দুবাই রুটের উভয় ফ্লাইটই বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার দিয়ে পরিচালনার কথা ছিল। কিন্তু উড়োজাহাজের সংকটে বিকল ৩টা ৪৫ মিনিটের ঢাকা-কুয়েত রুটের বিজি ৩৪৩ ফ্লাইট এবং বিকাল ৫টা ৫ মিনিটের ঢাকা-চট্টগ্রাম-দুবাই ফ্লাইট দুটিই বাতিল করতে হয়েছে। 

বিমানের সূত্রগুলো বলছে, গত এক মাসে উড্ডয়নের আগে-পরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অন্তত ১৫টি উড়োজাহাজে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়েছে। মে মাসে কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে শিশুসহ ৭১ যাত্রী যাত্রা করেছিল একটি উড়োজাহাজ। উড়ার পরপরই এর বামদিকের ল্যান্ডিং গিয়ারের একটি চাকা খুলে যায়। বিমানটির প্রকৌশল বিভাগের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, বিয়ারিং কাজ না করার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। পরে ক্যাপ্টেনের দক্ষতায় সেটি ঢাকায় নিরাপদে অবতরণ করে। এ ছাড়া সর্বশেষ গত ৩০ দিনে ঢাকাসহ আবুধাবী, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর ও কুয়ালালামপুর রুটের একাধিক আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে মাঝ আকাশে যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। কোথাও টয়লেটের ফ্লাশ বিকল হয়ে ফেরত আসতে হয়েছে, কোথাও ইঞ্জিনে ত্রুটি ধরা পড়ে জরুরি অবতরণ করতে হয়েছে। কিছু ফ্লাইট যাত্রা শুরু করার পরই মিয়ানমার বা ভারতের আকাশ থেকে ফিরে আসে, আবার কিছু ফ্লাইট উড্ডয়নের আগে রানওয়েতে আটকে যায়। এর ফলে শত শত যাত্রীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমান বন্দরে অপেক্ষা করতে হয়েছে, অনেকের সংযোগ ফ্লাইট মিস হয়েছে, কেউ কেউ গন্তব্যে যেতে পারেননি। অভিযোগ উঠেছে, বিমানের হ্যাঙ্গারে কর্মরত প্রকৌশলীরা উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণে দায়সারা কাজ করছেন। নির্ধারিত ‘চেক’ ও ‘সার্ভিসিং’ সঠিকভাবে না হওয়া, অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর ঘাটতি এবং যন্ত্রাংশের অভাবে ত্রুটি বেড়ে চলছে। একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনায় চলতি মাসে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিমান কর্তৃপক্ষ। সেইসঙ্গে যেকোনো উড়োজাহাজ উড্ডয়নের আগে পূর্ণাঙ্গ কারিগরি পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। সর্বশেষ গত রোববার বিমানের প্রকৌশল বিভাগের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন এয়ারলাইন্সটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কিন্তু এসব বৈঠক ও জরুরি নির্দেশনা কোনো কাজে আসছে না। 

১০ই আগস্ট রোমে ডানার ফ্ল্যাপ বিকল হওয়ার সমস্যা শেষ হতে না হতে পরদিন সোমবার ড্যাস-৮ মডেলের একটি উড়োজাহাজের কেবিনের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ২০ মিনিট উড়ে ঢাকায় ফিরে আসে চট্টগ্রামগামী একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট। পরে যাত্রীদের অন্য একটি উড়োজাহাজে চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। এ দু’টি ঘটনা ছাড়াও চলতি আগস্ট মাসে আরও তিনটি উড়োজাহাজে যান্ত্রিক ত্রুটিতে পড়ে বিমান। ৬ই আগস্ট ব্যাংককগামী একটি বোয়িং ৭৩৭ ইঞ্জিনে অতিরিক্ত কম্পন অনুভূত হওয়ায় মিয়ানমারের আকাশ থেকে ফিরে আসে। ৭ই আগস্ট আবুধাবীগামী একটি বোয়িং তিনটি টয়লেটের ফ্লাশ বিকল হওয়ায় ১ ঘণ্টা উড়ে ঢাকায় ফিরে আসে। ৯ই আগস্ট সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমান বন্দরে পৌঁছানোর পর একটি বোয়িংয়ে সমস্যা দেখা দিলে তা সারিয়ে ২ ঘণ্টা বিলম্বে ঢাকায় ফেরানো হয়। বিমানের প্রকৌশল বিভাগের তথ্য বলছে, ৬ই আগস্ট মিয়ানমারের আকাশ থেকে ফিরে আসা ব্যাংককগামী বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজটি প্রায় আট মাস হ্যাঙ্গারে রেখে মেরামত করা হয়েছিল। গত জুলাই মাসেও বিমানের উড়োজাহাজে ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে। ১৬ই জুলাই দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ‘চাকায় ত্রুটি’র কারণে একটি বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার গ্রাউন্ডেড হয়, যা মেরামতের পর ৩০ ঘণ্টা বিলম্বে দেশে ফেরে। ২৪শে জুলাই দুবাই থেকে আসা আরেকটি ড্রিমলাইনারের ল্যান্ডিং গিয়ারের দরজা ঠিকভাবে বন্ধ না হওয়ায় সেটি চট্টগ্রামে ফিরে আসে এবং ত্রুটি সারিয়ে ২ ঘণ্টা পর আবার ঢাকায় যায়। ২৮শে জুলাই দাম্মামগামী একটি বোয়িং ৭৭৭-ইআর কেবিন প্রেশারের ত্রুটির সংকেত পেয়ে ঢাকায় ফিরে আসে, পরে যাত্রীদের অন্য উড়োজাহাজে পাঠানো হয়। ৩০শে জুলাই শারজা বিমান বন্দরে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে একটি বোয়িং ৭৩৭ ছয় ঘণ্টা আটকে থাকে। 

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্লাইট পরিচালনা শেষে পাইলটরা টেকনিক্যাল সব সমস্যার কথা লিখে রাখেন।  সেগুলো রেক্টিফাই করা ও পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য এয়ারক্রাফট সঠিকভাবে প্রস্তুত রাখা ইঞ্জিনিয়ারিং টিমের দায়িত্ব। মেরামত করেই উড়োজাহাজটি পাইলটকে বুঝিয়ে দিতে হয়। বিমানের সামপ্রতিক ধারাবাহিক যান্ত্রিক ত্রুটিগুলো কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত রক্ষণাবেক্ষণ-ব্যবস্থার প্রতিফলন। তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বহরের উড়োজাহাজগুলো নিয়মিত ও পূর্ণাঙ্গভাবে পর্যবেক্ষণ এবং মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষার আওতায় না আসায় ছোটখাটো কারিগরি সমস্যা সময়মতো ধরা পড়ছে না। ফলে এসব ত্রুটি ধীরে ধীরে জটিল আকার ধারণ করে উড্ডয়ন-নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না, যা শুধু আর্থিক ক্ষতিই নয়, যাত্রীদের জীবনহানির ঝুঁঁকিও বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এ বি এম রওশন কবীর বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য ফ্লাইট বিলম্ব হয়েছে। যাত্রীদের কিছুটা অসন্তুষ্টি তো আছেই। আমাদের প্রকৌশলীরা দিনরাত পরিশ্রম করছেন। তারা অনুসন্ধানও করেছেন কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তবে প্রতিটা সমস্যাই আলাদা সমস্যা। একটার সঙ্গে আরেকটার মিল নাই। যখনি কোনো ত্রুটি ধরা পড়ছে সেটি সঙ্গে সঙ্গে মেরামত করা হচ্ছে। হ্যাঙারে নেয়া হচ্ছে বা কোথাও গ্রাউন্ডেড হচ্ছে। এজন্য ফ্লাইট বিলম্বিত হচ্ছে এবং অন্য এয়ারক্রাফটগুলোর ওপর চাপ পড়ছে। তিনি বলেন, এ ধরনের সমস্যা আগেও হয়েছে তবে এত কম সময়ের মধ্যে আর হয়নি। 

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, প্রথমত উড়োজাহাজগুলো ফুল চেকআপ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, লগবুকে যেসব ত্রুটির বিষয় লিখা থাকে সেগুলোও চেক করতে হবে প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া সেগুলো সঠিকভাবে নাকি দায়সারাভাবে করা হয়েছে সেটিও মনিটরিং করতে হবে। তৃতীয়ত, যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো নীরিক্ষা করতে হবে। যদি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি কেনা হয় তবে কোনো কথা নাই। আর সরবরাহকারীর কাছ থেকে নেয়া হলে মানটা ভালোভাবে দেখতে হবে। মান কারা নিশ্চিত করেছে ও সঠিকভাবে করা হয়েছে কিনা সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। কিছু পার্টসের মেয়াদ অনেক বেশি দেয়া থাকে। অনেক সময় তার আগেই লাইফ শেষ হয়ে যায়। কারণ অনেক কোম্পানি খারাপ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। তাই এসব বিষয়ের অডিট হওয়া দরকার। তিনি বলেন, যেসব ত্রুটি দেখা দিচ্ছে সেগুলো বিপদের ইঙ্গিত। তার আগে সতর্ক হতে হবে। আর বিমানের প্রকৌশল বিভাগকে এসব বিষয়ে আরও  বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এই বিভাগ ছাড়াও অন্যান্য যেসব বিভাগ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের কো-অর্ডিনেশনটাও জরুরি।