Image description

দেশের ইতিহাসে চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া প্ল্যাটফর্মের নাম ‌‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের পর একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে এ প্ল্যাটফর্মের শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন সারাদেশে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এ প্ল্যাটফর্মের তরুণ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য—ঘুস, দুর্নীতি, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাস, দখলদার মুক্ত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ।

 

তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্ল্যাটফর্মটিকে কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু জায়গায় নানান অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। তেমনই এক ঘটনা ঘটেছে উত্তরের জেলা নওগাঁর মান্দা উপজেলায়। নওগাঁ-রাজশাহী আঞ্চলিক মহাসড়কের ফেরিঘাট ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের প্রায় এক কোটি টাকা মূল্যের জমিতে অবৈধভাবে রেস্তোরাঁ নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নওগাঁয় নেতৃত্ব দেওয়া তিন ছাত্র প্রতিনিধির বিরুদ্ধে। বদলির আগে জমিটি অবৈধ দখলে নিয়ে তাদের উপহার দিয়েছেন খোদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।

সরকারি জমি দখলে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী তিন শিক্ষার্থীর রেস্তোরাঁসড়ক ও জনপথের জমিতে রেস্তোরাঁ। ছবি-জাগো নিউজ 

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের পর গত বছরের ৫ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৫ জুলাই পর্যন্ত মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে কাজ করেন শাহ আলম মিয়া। এ সময়ের মধ্যে তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নওগাঁয় নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র প্রতিনিধি রিপন, ফাহিম ও সজিব নামের তিন শিক্ষার্থীর। ইউএনওর বৈধ-অবৈধ সব কাজে সরাসরি সহযোগিতা করতেন তারা। বিনিময়ে বদলির আগে তাদের উপহার হিসেবে সড়ক বিভাগের কোটি টাকা মূল্যের জমি অবৈধ দখলে নিয়ে উপহার হিসেবে দেন ইউএনও। এরপর ওই জমিতে একটি রেস্তোরাঁ তৈরি করেন ওই তিন যুবক। ‘‌মান্দা রিভার কোর্ট’ হিসেবে যার নামকরণ করেন ইউএনও শাহ আলম মিয়া। বদলির আগের দিন ১৪ জুলাই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সেটি উদ্বোধনও করেন তিনি।

“উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা হলেও পড়ালেখা করার সুবাদে ওই তিন শিক্ষার্থী মান্দায় থাকেন না। উপজেলা প্রশাসনের শেল্টারে সেখানে কংক্রিটের স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করেছেন তারা। ওই সময়ে কেউ বাধা দিতে গেলে তাদের পুলিশি হয়রানিসহ নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখানোর পাশাপাশি বলা হয়েছে—‘এটি তারা সড়ক বিভাগ থেকে ১০০ বছরের জন্য লিজ নিয়েছেন’। সড়কের একটি অংশ কেটে ওই রেস্তোরাঁয় নামার রাস্তাও করেছেন তারা।”

উদ্বোধনী নামফলকে নিজের পরিকল্পনা ও ভাবনার বিষয়টি উল্লেখ করে উদ্বোধক হিসেবে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালের নাম উল্লেখ করান শাহ আলম মিয়া।

 স্থানীয়দের অভিযোগ, উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা হলেও পড়ালেখা করার সুবাদে ওই তিন শিক্ষার্থী মান্দায় থাকেন না। উপজেলা প্রশাসনের শেল্টারে সেখানে কংক্রিটের স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করেছেন তারা। ওই সময়ে কেউ বাধা দিতে গেলে তাদের পুলিশি হয়রানিসহ নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখানোর পাশাপাশি বলা হয়েছে—‘এটি তারা সড়ক বিভাগ থেকে ১০০ বছরের জন্য লিজ নিয়েছেন’। সড়কের একটি অংশ কেটে ওই রেস্তোরাঁয় নামার রাস্তাও করেছেন তারা।

সরকারি জমি দখলে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী তিন শিক্ষার্থীর রেস্তোরাঁআনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় রেস্তোরাঁ

সড়ক বিভাগের জমিতে রেস্তোরাঁ নির্মাণের বিষয়ে কথা বলতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ফাহিম রহমানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘জায়গাটিতে অবৈধভাবে রেস্তোরাঁ নির্মাণের অভিযোগটি সঠিক নয়। জমিটি লিজ নেওয়ার উদ্দেশ্যে সড়ক ও জনপথ বিভাগে চলতি বছরের এপ্রিলে একটি আবেদন করেছিলাম। লিজ নেওয়ার প্রক্রিয়াটি অনেকটাই এগিয়েছে। এ কাজে সার্বিক পরামর্শ দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করেছেন সাবেক ইউএনও শাহ আলম মিয়া।’

 

আরেক শিক্ষার্থী প্রতিনিধি রিপন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সড়ক বিভাগের জমিতে স্থায়ী কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা হয়নি। শুধু কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণ করে ওপরে টিনশেড দিয়ে আপাতত রেস্তোরাঁর কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। জায়গাটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কখনো কোনো দপ্তরে আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মের পরিচয় ব্যবহার করিনি।’

সরকারি জমি দখলে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী তিন শিক্ষার্থীর রেস্তোরাঁসাবেক ইউএনওর সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন প্রতিনিধি

এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত থেকে প্রশাসনের সঙ্গে লিঁয়াজো করে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই বলে জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নওগাঁয় নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ফজলে রাব্বী।

 

‘তরুণ উদ্যোক্তা পরিচয়ে জমিটি লিজ নিতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আবেদন করেছিলেন। এরপরই বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। এখনো এ-সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। এরই মধ্যে আমরা জায়গাটিতে স্থাপনা নির্মাণের খবর পেয়েছি, যা সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত। অবৈধ স্থাপনাটি ভেঙে ফেলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। আমরা দখলদার-চাঁদাবাজদের দমনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করছি। তিন ছাত্র প্রতিনিধির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগটি ক্ষতিয়ে দেখা হোক। সত্যতা পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।’

 মান্দা উপজেলার সাবেক ইউএনও শাহ আলম মিয়া বদলিসূত্রে বর্তমানে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন একাডেমি ঢাকায় উপপরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে কর্মরত। সরকারি জায়গা অবৈধ দখলে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র প্রতিনিধিদের উপহার দেওয়ার বিষয়ে জানতে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। মোবাইল নম্বর এবং হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য চেয়ে মেসেজ পাঠালোও উত্তর দেননি। এক পর্যায়ে তার অফিসিয়াল ফোন নম্বরে কল করা হলে কথোপকথনের এক পর্যায়ে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কল কেটে দেন।

 

সরকারি জমি দখলে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী তিন শিক্ষার্থীর রেস্তোরাঁ

নওগাঁ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘তরুণ উদ্যোক্তা পরিচয়ে জমিটি লিজ নিতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আবেদন করেছিলেন। এরপরই বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। এখনো এ-সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। এরই মধ্যে আমরা জায়গাটিতে স্থাপনা নির্মাণের খবর পেয়েছি, যা সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত। অবৈধ স্থাপনাটি ভেঙে ফেলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

নামফলকে উদ্বোধক হিসেবে নাম থাকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল জাগো নিউজকে বলেন, ‘মান্দায় স্থানীয় যুবকদের উদ্যোগে নির্মিত একটি রেস্তোরাঁ উদ্বোধনের বিষয়ে সাবেক ইউএনও শাহ আলম আমাকে জানিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার সময়-সুযোগ হয়নি। তবে নামফলকে আমার নাম উল্লেখের বিষয়ে স্পষ্টভাবে আমাকে কিছু জানানো হয়নি। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি নজরে এলে ওই যুবকদের ডেকে নামফলকটি সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতিক্রমে সেখানে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বলা হয়েছে।’