
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কিছুটা স্বস্তিদায়ক ছিল। বছর ঘুরতেই হুট করে বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। চালসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন গড়পড়তা আয়ের মানুষ।
খোদ সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবই বলছে, গত এক বছরের ব্যবধানে এখন বাজারে বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে।
সরকারের এ সংস্থাটি বাজারের ৩৩ ধরনের নিত্যপণ্যের প্রতিদিনের দাম কমা-বাড়ার হিসাব রাখে। টিসিবির মঙ্গলবারের (১২ আগস্ট) বাজারদর অনুযায়ী, ৩৩ পণ্যের মধ্যে বছর ব্যবধানে ১৭ পণ্যের দাম বাড়তি। কমেছে ১৫টির। আর স্থিতিশীল একটির।
হুট করে দাম বাড়ার মতো সুনির্দিষ্ট কোনো পরিস্থিতি না থাকলেও কিছু কিছু পণ্যের দামে অস্থিতিশীলতা দেখা যাচ্ছে। যে জন্য ওইসব নির্দিষ্ট পণ্যের ব্যবসায়ীদের মনিটরিং প্রয়োজন। যারা বাজার মনিটরিং করছেন তাদের দেখা প্রয়োজন আসলে কী কারণে এটা হচ্ছে, এর মধ্যে কোনো অসংগতি রয়েছে কি না।- মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজি বশির উদ্দিন
তবে ওই বাজারদর বিশ্লেষণে দেখা যায়, যেসব পণ্য বেশি প্রয়োজনীয় সেগুলোর দাম বেড়েছে। অর্থাৎ, সেসব পণ্যের চাহিদা সব সময়ই থাকে।
অন্যদিকে দাম কমার তালিকায় বেশি প্রয়োজনীয় পণ্য হচ্ছে চিনি, ডিম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও শুকনা মরিচ। রয়েছে তিন ধরনের ডাল মুগ, অ্যাংকর ও ছোলা। বাকি চার পণ্য হলো- জিরা, দারুচিনি, লবঙ্গ, ধনিয়া। আরেকটি পণ্য এমএস রড। আর একটিমাত্র স্থিতিশীল পণ্য হচ্ছে লবণ।
এমএস রড ও লেখার কাগজ, এ দুটি পণ্যের দাম খাদ্যপণ্যের বাইরে নিয়মিত হিসেবে রাখে টিসিবি।
এসব পণ্যের পাশাপাশি বাজারে এখন সবজির দামও ব্যাপক চড়া। টিসিবির তালিকায় আলু ছাড়া অন্য সবজির দাম থাকে না। তবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাজারদরের তালিকায় বিভিন্ন ধরনের সবজির দর উল্লেখ করা হয়। ওই সংস্থার তথ্য বলছে, শুধু আলু ও পেঁপে ছাড়া অন্য সব সবজির দাম গত এক বছরের ব্যবধানে ১৪ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এছাড়া বাজারে ফলের দাম বাড়ার বিষয়টি উঠে এসেছে সংস্থাটির তথ্যে। গত বছরের চেয়ে এবার ফলের দাম বেড়েছে ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত।
এছাড়া টিসিবির ওই প্রতিবেদনে এখন পেঁয়াজ ও ডিমের দাম বেশি থাকলেও গত বছরের একই সময়ের চেয়ে কম থাকায় নিম্নমুখী তালিকায় রয়েছে। কারণ গত বছর ওই সময়ও এ দুটি পণ্যের দাম আরও বেশি ছিল।
টিসিবির বাজারদরের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় এখন মোটা চাল কেজিতে ৫-৭ টাকা, আটা ২-৫ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ১৭ টাকা, ভালো মানের ছোট দানার মসুর ডাল ২০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ৫ টাকা, রুই মাছ ৫০ টাকা, গরুর মাংসের দাম ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
সরকারের সঠিক মনিটরিং না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা করছে। হুট করেই সবাই মিলে সিন্ডিকেটে নেমেছে। যে কারণে অল্প সময়ের মধ্যে অনেক পণ্যের দামে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।- ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন
টিসিবির ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তালিকার বাইরেও বেশকিছু ওষুধ, গৃহস্থালি পণ্য ও প্রসাধনীর মতো অনেক প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে।
বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে বিপদে নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষ। রামপুরা বাজারে বিলকিস বেগম নামে একজন ছোট চাকরিজীবী বলেন, ‘বাজারে কোনো জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। যে যার মতো দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। এতে আমাদের কেনার ক্ষমতা কমছে। দামে রীতিমতো হাঁসফাঁস। প্রতিনিয়ত বাজারের তালিকা থেকে পণ্য বাদ দিতে হচ্ছে।’
শান্তিনগর বাজারের ক্রেতা মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘হঠাৎ করে পেঁয়াজসহ অনেক নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় বিপাকে আছি। বাজারে সবজির দামও চড়া। কদিন আগে ৪০ টাকায় ঢেঁড়শ পাওয়া গেলেও আজ ৮০ টাকা চাচ্ছে। মাছ-মাংসের দামও বেশি। আমাদের নাভিশ্বাস অবস্থা।’
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজি বশির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘হুট করে দাম বাড়ার মতো সুনির্দিষ্ট কোনো পরিস্থিতি না থাকলেও কিছু কিছু পণ্যের দামে অস্থিতিশীলতা দেখা যাচ্ছে। যে জন্য ওইসব নির্দিষ্ট পণ্যের ব্যবসায়ীদের মনিটরিং প্রয়োজন। যারা বাজার মনিটরিং করছেন তাদের দেখা প্রয়োজন আসলে কী কারণে এটা হচ্ছে, এর মধ্যে কোনো অসংগতি রয়েছে কি না।’
এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা দাম কমাতে যে কোনো দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে পারবেন।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব পণ্যের দাম কমাতে সুনির্দিষ্ট বেশকিছু পদক্ষেপ দরকার। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকারের সঠিক মনিটরিং না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা করছে। হুট করেই তারা সবাই মিলে সিন্ডিকেটে নেমেছে। যে কারণে অল্প সময়ের মধ্যে অনেক পণ্যের দামে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘পর্যাপ্ত আমদানি থাকার পরও পরিস্থিতি কারা অস্বাভাবিক করলো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। শুল্ক বাড়ানোর কথা বলে ফলের দাম এত বাড়লো। কিন্তু বাস্তবে শুল্ক বৃদ্ধি ও প্রকৃত দামবৃদ্ধির মধ্যে বড় ফারাক রয়েছে। ওই অজুহাতে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের অসাধু সিন্ডিকেট আগের মতোই দাম বাড়াচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাজারে কেনো মনিটরিং নেই। সরকারের এজেন্সিগুলো তৎপর নয়। তারা নানান প্রটোকলে ব্যস্ত, ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’
স্বল্প আয়ের পরিবারে চাপ পড়ে কিছু নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে। বহু পণ্যের দাম আগে থেকেই বাড়তি। কিন্তু সেই মূল্যস্ফীতি অনুযায়ী মানুষের মজুরিও বাড়ছে না। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমেছে। এমনটাই মনে করছেন অনেকে।