
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে দেয়া এক অভিযোগে জেবুন্নাহার দাবি করেন, তার স্বামীকে ‘জঙ্গি’ অপবাদ দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং তাকেও দুই শিশুকন্যাসহ ৪ মাস ৭ দিন গুম করে অমানবিক নির্যাতনের শিকার করা হয়েছে।
২০০৯ সালের ২৫ ফেরুয়ারি ঘটে যাওয়া দেশের ইতিহাসের ভয়াবহতম বিডিআর হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী লীগ সরকারের মদদ ও প্রতিবেশী ভারতের সম্পৃক্ততার তথ্য জানার অপরাধেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা মেজর (অব:) জাহিদুল ইসলামকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন তার স্ত্রী জেবুন্নাহার ইসলাম।
গতকাল রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে দেয়া এক অভিযোগে জেবুন্নাহার দাবি করেন, তার স্বামীকে ‘জঙ্গি’ অপবাদ দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং তাকেও দুই শিশুকন্যাসহ ৪ মাস ৭ দিন গুম করে অমানবিক নির্যাতনের শিকার করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে নতুন অভিযোগ পাওয়ার খবর দৈনিক নয়া দিগন্তকে নিশ্চিত করে প্রসিকিউটর গাজী এইচ তামিম বলেছেন, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মেজর (অব:) জাহিদুল ইসলামকে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে হত্যা এবং তার দুই মেয়ে এবং স্ত্রীকে গুমের ঘটনার একটি অভিযোগ গতকাল ট্রাইব্যুনালে জমা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ জমা দেয়ার পর জেবুন্নাহারের পক্ষে গণমাধ্যমের সাথে কথা বলেন তার আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সারোয়ার হোসেন। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংসতম ঘটনার একটি মেজর জাহিদকে হত্যা। মূলত বিডিআর বিদ্রোহে আ’লীগ ও ভারত সম্পৃক্ততা জেনে যাওয়ায় মেজর জাহিদকে হত্যা করা হয়েছিল।
যে সব ব্যক্তিদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তারা হলেন : সাবেক আইজিপি এ কে এম শহিদুল হক; ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান মো: মনিরুল ইসলাম; সিটিটিসির সাবেক প্রধান মো: আসাদুজ্জামান; মিরপুর বিভাগের তৎকালীন ডিসি মাসুদ আহমেদ; রূপনগর থানার তৎকালীন ওসি সহিদ আলম; রূপনগর থানা-পুলিশের তৎকালীন অজ্ঞাত সদস্যরা।
জেবুন্নাহার তার অভিযোগে বলেন, ২০০৯ সালে সরকারের বাছাইকৃত সেনা অফিসারদের পিলখানায় পোস্টিং দেয়া হয় এবং সেই তালিকায় মেজর জাহিদেরও নাম ছিল। জাহিদ তার পোস্টিংয়ে আগ্রহী ছিলেন না বিধায় তিনি সেখানে যোগদান করেননি। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সেনা কর্মকর্তাদের ওপর এক মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। তখন পিলখানায় জাহিদের কোর্সমেট শহীদ ক্যাপ্টেন মো: মাজহারুল হায়দার পিলখানায় পোস্টিং ছিল। ঘটনার দিন শহীদ ক্যাপ্টেন মাজহারুল হায়দার ভাই জাহিদকে ফোন দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন দোস্ত আমাদের সব অফিসারকে মেরে ফেলেছে। তখন জাহিদ জিজ্ঞাস করেছিলেন কারা? মাজহার ভাই বলেছিলেন কিছু হিন্দিভাষী বাংলাদেশী বিডিআরের জোয়ানদের ড্রেস পরিহিত যাদেরকে কখনোই পিলখানায় আগে দেখেননি উনি। জাহিদ তখন বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। ঘটনা শুনে তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন এবং সাথে সাথেই বগুড়া ক্যান্টনমেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরকে জানান। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পর জাহিদ অনেক মর্মাহত হন এবং পিলখানা হত্যার সুষ্ঠু বিচারের জন্য বিভিন্ন অফিসারের সাথে আলোচনা করেন। যেহেতু জাহিদ পিলখানা হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন এবং পিলখানা হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে মাজহারুল ভাইয়ের কাছ থেকে অনেক কিছুই জেনে গিয়েছিলেন তাই ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার মেজর জাহিদুল ইসলামকে (অব:) টার্গেট করে নজরদারি করতো। জাহিদের মতো অনেক সেনা অফিসার পিলখানা হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারেননি। ব্যক্তিগতভাবে জাহিদ ছিলেন ধর্মভীরু এবং ইসলামের সব বিধিবিধান পালনে সচেষ্ট।
তিনি বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের কারণে সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি অস্থিরতা বিরাজ করছিল। সে সময় হাসিনার সরকার এ হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার এবং সুষ্ঠু তদন্ত হতে দেয়নি। সেনাবাহিনীতে অযোগ্য অফিসারের পদোন্নতি এবং বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলতা জাহিদ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না। জাহিদ কানাডা থেকে এসে যখন দেখলেন চাটুকারদের এবং অযোগ্য অফিসারদেরকে প্রমোশন দিচ্ছে তখন জাহিদ ডিসিশন নিলেন চাকরি ছেড়ে দিবেন। উনি চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলে আমি তাকে বাধা দিইনি। জাহিদ চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর আমরা উত্তরায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করি।
চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর থেকে সার্বক্ষণিক নজরদারির কথা উল্লেখ করে জেবুন্নাহার ইসলাম বলেন, ২০১৫ সালে জাহিদ চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর থেকে হাসিনার সরকারের গোয়েন্দারা সার্বক্ষণিক নজরদারি করত। হাসিনা সরকার পরিকল্পনা করে জাহিদকে কিভাবে মেরে ফেলা যায়। যখন দেখলো জাহিদ অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ এবং নামাজ রোজা করেন। তিনি একটি বেসরকারি ইসলামিক ভাবধারার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। জাহিদ খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিলেন যে তার উপর এবং তিনি যাদের সাথে চলাফেরা করছেন তাদের উপরও নজরদারি করা হচ্ছে। তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় আমরা উত্তরা থেকে রূপনগরে স্থানান্তরিত হই। কিন্তু হাসিনা অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে জাহিদকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা তার সূক্ষ্ম পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর জঙ্গি নাটক সাজিয়ে শহীদ মেজর মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলামকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি মুখোমুখি হন নিষ্ঠুর ও জঘন্যতম নির্যাতনের। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার স্বামী শহীদ মেজর জাহিদুল ইসলামকে হত্যার পর আমার উপর নেমে আসে অমানবিক, নিষ্ঠুর ও জঘন্যতম নির্যাতন। ১ ও ২ নং আসামির পরিকল্পনা অনুযায়ী যে বাসায় আমার স্বামীকে জঙ্গি তকমা দিয়ে হত্যা করা হয়। তখন পর্যন্ত আমি জানতে পারি নাই যে, আমার স্বামীকে জঙ্গি তকমা দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তার আগে ওই বাসা থেকে ৩ ও ৪ নং আসামির নির্দেশনায় ৫ ও ৬ নং আসামিরা আমাকে এবং আমার ১ বছরের দুধের বাচ্চাসহ বড় মেয়েকে মাইক্রোবাসে করে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। উল্লেখ্য, ২ নং আসামি ছিলেন ঐ সময়ের জঙ্গি নাটক সাজানোর প্রধান কারিগর। জঙ্গি নাটক করে আমাকে এবং আমার মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়ে ডিবির কথিত আয়না ঘরে ৪ মাস ৭ দিন আটকে গুম করে রাখে এবং আমাকে ও আমার মেয়েকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। আমার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে আমার উপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। আমাকে হুমকি দেয় যে, আমি যেন আমার স্বামীকে জঙ্গি বলে স্বীকার করি। আমাকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধমকি দেয় আমি যদি স্বীকার না করি আমাকে এবং আমার দুই মেয়েকে আমার স্বামীর মতোই পরিণতি স্বীকার করতে হবে অর্থাৎ হত্যা করা হবে। দীর্ঘদিন আমার থেকে কোনো রকমের স্বীকারোক্তি না পেয়ে আমার বড় মেয়েকে আমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে কথিত জঙ্গি নাটক সাজিয়ে আজিমপুরের একটি বাসা থেকে তাকে উদ্ধার দেখায় এবং কিশোর ভিকটিম সেন্টারে নিয়ে যায়।
২০১৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর আরো একটি জঙ্গি নাটক সাজিয়ে আশকোনার একটি বাসা থেকে আমাকে উদ্ধার দেখায়। তার পর আমাকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায় এবং আসামিরা যোগসাজশে আমার বিরুদ্ধে দুটি ও আমার মৃত স্বামীর বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে। ডিবি কার্যালয়ে আরো ১৬ দিন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিক টর্চার করতে থাকে। ১৬ দিন পর কাশিমপুর কারাগারে প্রেরণ করে। তখন আমি জানতে পারি, আমাকে যে দিন আমার বাসা থেকে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়ার কিছুক্ষণ পরেই সে দিন আমার স্বামীকে পেছনে হাত বেঁধে বাসার নিচে নামিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংসভাবে হত্যা করে। এর পর দীর্ঘ চার বছর জেলে থাকার পর আমি জামিনে বের হই এবং আমি দুই বছর জামিনে থাকি কিন্তু এই ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার দুই বছর পর আমার জামিন বাতিল করে দেয়। ফ্যাসিস্ট হাসিনার ভয় ছিল আমি জামিনে থাকা অবস্থায় যদি আমার স্বামীর হত্যার বিচার চাই, এই সন্দেহ করে আমার জামিন বাতিল করে দেয়। ২০২২ এর ৩১ আগস্ট আমাকে আবার জেলখানায় পাঠায় এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর আমি ৩১ আগস্ট ২০২৪ তারিখে আবার জামিনে মুক্ত হই।
মেজর জাহিদুল ইসলাম ২০০০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৩তম বিএমএ লং কোর্স থেকে কমিশন পান। তার কোর্স পজিশন ছিল তৃতীয় এবং তিনি ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ গোল্ড মেডেল অর্জন করেন। তার কর্মজীবনে ছিল কঙ্গোতে শান্তিরক্ষা মিশন, পাকিস্তানে মিড ক্যারিয়ার কোর্স, স্টাফ কলেজ পাস করে কানাডায় উচ্চতর কোর্স সম্পন্ন, সিলেট এবং বগুড়ায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনসহ সুদীর্ঘ সুনামের ইতিহাস।
চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে জেবুন্নাহারের সাথে ছিলেন কর্নেল (অব:) হাসিনুর রহমান বীর প্রতীক এবং অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্র বাহিনী কর্মকর্তাদের কল্যাণ সমিতির যুগ্ম সম্পাদক লে. কর্নেল (অব:) নওরোজ খুরশিদ আলম। তারা বলেন, মেজর জাহিদের পরিবারের সাথে ক্লাবের পক্ষ থেকে সব ধরনের আইনি সহায়তা প্রদান করা হবে।