Image description

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে পুলিশের গুলিতে ছাত্র-জনতা নিহত হওয়ার ঘটনায় গণহত্যা মামলার তদন্ত ধীরগতিতে চলছে। ওই সময় সারা দেশে বিভিন্ন ঘটনায় ১ হাজার ৭৩০টি মামলা হয়েছিল। এরমধ্যে পুলিশের গুলিতে নিহতের ঘটনায় হত্যা মামলা হয়েছে ৭৬১টি। সব ধরনের মামলায় প্রায় ১ বছর পরে এখন পর্যন্ত চার্জশিট দেয়া হয়েছে মাত্র ১৯টি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ইতিহাসে আর কোনো আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে এত মানুষ নিহত হওয়ার নজির নেই। ছাত্র-জনতার ওই আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় যেসব মামলা হয়েছে সেসব মামলার তদন্ত শেষ হতে বহু বছর লেগে যাবে। মামলার এজাহারে ত্রুটি, সঠিক ঘটনাস্থল উল্লেখ না করা, ময়নাতদন্ত ছাড়া নিহতদের মরদেহ দাফন, মরদেহ উত্তোলন না করা, ডেড সার্টিফিকেটে মৃত্যুর সঠিক কারণ উল্লেখ না করা, ফরেনসিক রিপোর্ট পেতে দেরি, ঢালাও আসামি, তদন্ত কর্মকর্তা বদলিসহ নানা কারণে এসব মামলার তদন্তে ধীরগতি দেখা দিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশের ওপর বড় ধরনের ধাক্কা আসে। আত্মগোপনে চলে যায় অনেক পুলিশ সদস্য। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর নানা উদ্যোগ নিয়ে পুলিশকে কাজে ফেরানো হলেও মনোবলহারা পুলিশ কাজে মনোযোগ দিতে পারেনি। ঠিক তখনই গণ-অভ্যুত্থানের মামলা শুরু হয়। দেশ জুড়ে মামলাবাজ চক্র গড়ে ওঠে। তারা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ব্যক্তিগত-ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, পেশাগত দ্বন্দ্ব, টাকার বিনিময়ে মামলার আসামি, ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলার বাদীকে রাজিসহ ঢালাও আসামি করে শত শত মানুষকে। ওইসময় রাতারাতি মামলা করার জন্য ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা না দিয়ে ভুল ঘটনাস্থলের কথা উল্লেখ করে মনগড়া মামলা করা হয়। যেখানে মামলার আসামি ২০ জন হওয়ার কথা সেখানে কোনো কোনো মামলায় ২শ’ থেকে ৩শ’ মানুষকে আসামি করা হয়। প্রতিহিংসা ও মামলা বাণিজ্যের কারণে অনেক নিরীহ মানুষকে আসামি করা হয়। বিদেশে ছিলেন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন এমন ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। অপরাধ না করেও যেসব নিরীহ মানুষকে আসামি করা হয়েছে তারা এখন স্বাভাবিক জীবনযাপনও করতে পারছেন না। আর মামলায় ঢালাও আসামি ও মনগড়া এজাহারসহ নানা ত্রুটির কারণে ঢিমেতালে মামলার তদন্ত চলছে। এসব মামলা নিয়ে খোদ তদন্ত কর্মকর্তারাই হতাশ। 

এ ছাড়া অপরাধ বিশেষজ্ঞ, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, সিনিয়র আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মীসহ সরকারের তরফ থেকে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ঢালাও মামলার বিষয়টি ওঠে আসে। গত বছরের ১৪ই অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। সেখানে এ ধরনের মামলা করার মাধ্যমে যারা অপতৎপরতা চালাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেয়া হয়। পরে মামলা তদারকে বিশেষ মনিটরিং দল গঠন করে পুলিশ সদর দপ্তর। বর্তমানে সারা দেশে ১০টি ‘মেন্টরিং অ্যান্ড মনিটরিং’ দলের মাধ্যমে মামলাগুলো তদারক করা হচ্ছে। এর মধ্যে আট বিভাগে আটটি, রাজধানীতে একটি ও গাজীপুরের জন্য একটি দল করা হয়েছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক প্রতিটি মনিটরিং দল নিয়ে বৈঠক করে মামলাগুলো বিশ্লেষণ করছেন। এ ছাড়া ঢালাও বা হয়রানিমূলক আসামি করার বিষয়ে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করতে প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সরকারি কৌঁসুলির (পিপি) সমন্বয়ে এবং মহানগরের ক্ষেত্রে পুলিশ কমিশনার ও বিভাগীয় কমিশনারের সমন্বয়ে কমিটি করা হয়েছে। এসব কমিটি তদন্তে অগ্রগতির বিষয়গুলোও পর্যবেক্ষণ করছে। 

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, মামলার বিচার শেষ করতে তাড়াহুড়ো করবে না তারা। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তদন্তে যদি সময় লাগে তবুও নিখুঁত তদন্ত প্রতিবেদন দিবে পুলিশ। যাতে আদালতে গিয়ে প্রতিবেদন ফেল না করে। তবে মামলা-বাণিজ্যসহ বিচারকাজের ধীরগতি নিয়ে হতাশ স্বজন হারানো পরিবারগুলো। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সাক্ষ্য-প্রমাণে দুর্বল হওয়ার কারণে এসব হত্যাকাণ্ডের মামলায় অপরাধীদের শাস্তি নিয়ে সংশয়, অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ১লা জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এক শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ওই সময় আওয়ামী লীগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা গ্রহণে এবং চিকিৎসকদের চিকিৎসায় বাধা দেয়। নিহত ব্যক্তিদের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করতে কিংবা প্রতিবেদনে মৃত্যুর সঠিক কারণ উল্লেখ করতেও বাধা দেয়, ভিন্ন কারণ লিখতে বাধ্য করে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ১৯টি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। হত্যা মামলা রয়েছে ৮টি, ১১টি অন্য ধারায়। ৮টি হত্যা মামলার মধ্যে তিনটি শেরপুর, বাকিগুলো ফেনী, চাঁদপুর, কুমিল্লা, কুড়িগ্রাম ও চট্টগ্রাম মহানগর এলাকার। অন্যদিকে ঢাকা ও বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকায় একটি করে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিনটি, সিরাজগঞ্জে দু’টি ও পাবনা ও জামালপুরে একটি মামলা রয়েছে। পিবিআই আরও দু’টি মামলার তদন্ত করছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বেশির ভাগ মামলা হয়েছে গত বছরের ১৯শে জুলাই এবং ৪ ও ৫ই আগস্টের হতাহতের ঘটনায়। এসব মামলায় সবচেয়ে বেশি তদারকি পুলিশ সদর দপ্তরের। ৬০ থেকে ৭০টি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে। পর্যায়ক্রমে এসব মামলার প্রতিবেদন দেয়া হবে বলে জানায় পুলিশ সদর দপ্তর।

সূত্র জানায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ১ হাজার ১৬৮ জন পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে পুলিশের সাতজন সাবেক আইজিপি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পদের সদস্যরা রয়েছেন। মামলায় তাদের বিরুদ্ধে গুলি করা কিংবা গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। দেড় হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন মাত্র ৬৩ জন। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দু’টি মামলায় ৯ পুলিশ সদস্যের বিচার শুরু হয়েছে। এ ছাড়া অন্য কোনো মামলার তদন্তই শেষ হয়নি। জানা গেছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে ডিএমপি’র বিভিন্ন থানায় রুজু হওয়া ৪৭টি মামলার তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ। মামলাগুলো ডিএমপি সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা নিয়মিত তদারকি করছেন। এ ছাড়া পুলিশ সদস্যরা আসামি থাকা মামলাগুলোর মধ্যে পিবিআই ৬৮টি মামলার তদন্ত করছে। 

পিবিআই সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পিবিআই’র তদন্তাধীন মামলাগুলোর মধ্যে ৩৪টি মামলায় ভিকটিমের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছে। শ্যোন অ্যারেস্টসহ পিবিআই এ পর্যন্ত ২১৫ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। এটি হচ্ছে মামলার এজাহারভুক্ত আসামির মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ। যদিও পিবিআই বলছে, তাদের কর্মকর্তারা মামলাগুলোর ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ তদন্তের কাজ এরই মধ্যেই শেষ করেছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিহতদের অধিকাংশ আলামতই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আসামিদের দোষী প্রমাণের পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করাও কঠিন। এ ছাড়া সাক্ষী হতে অনেকেই অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। ফলে তদন্তের ক্ষেত্রে এখন মোবাইল ফোনের সিডিআর, গণমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ ডিজিটাল প্রমাণের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে। পুলিশ আসামি থাকা মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সব স্পর্শকাতর মামলা। পুলিশ সদস্যরা আসামি থাকায় তদন্ত করতে হবে নির্ভুল। কারণ, তাদের বেশির ভাগ বাহিনীতে কর্মরত থাকায় তাড়াহুড়োর তদন্তে ভুল হলে বাহিনীতে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে। এ জন্য সব ধরনের প্রশ্ন ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে মামলাগুলোর তদন্ত করতে চান তারা।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, একটা মামলায় যখন ডজন ডজন আসামি করা হয়েছে, যারা করেছে তারা না বুঝেই করেছে। মামলায় তিনশ’ জনের নাম দিলেন। পুলিশকে তো এদের নামে কিছু না কিছু তদন্ত করে বের করতে হবে। একটা থানায় যে পরিমাণ এসআই থাকে তারা সবাই মিলে তদন্ত করলেও এসব মামলার চার্জশিট দিতে বহু বছর লাগবে। তাই এই মামলাগুলোর তদন্ত ও বিচার শেষ হতে ১০ বছর লাগলেও আমি অবাক হবো না। এখন হয়তো অনেক সাক্ষী বলবে আমার সামনে হয়েছে, আমি ঘটনা দেখেছি। কিন্তু ১০ বছর পরে তো তাকে ডাকলে পাওয়া যাবে না। তখন তো সাক্ষীর মনেও থাকবে না। কী ঘটেছিল। এর ভেতরে তদন্ত কর্মকর্তাও বদলি হবেন। নতুন তদন্ত কর্মকর্তা আসবেন। মূলকথা আওয়ামী লীগের সময় বিএনপিকে হেনস্তা করার জন্য যা করা হতো তারই পুনরাবৃত্তি হয়েছে। 

মানবাধিকার কর্মী ও গুমসংক্রান্ত কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেন, গণ-অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে যেসব মামলা হয়েছে তার অনেক ক্ষেত্রেই বাদীরা আসামিকে চেনেন না। বিভিন্ন মামলার নথিপত্র, এজাহার দেখে মনে হচ্ছে এগুলো সৃজনকৃত মামলা। এই সৃজনটা কে বা কারা করেছে এটা একটা বিষয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলা করার কথা বলে, নাম বাদ দেয়ার জন্য, নাম যোগ করার জন্য চাঁদাবাজিরও একটা বিষয় ছিল। এটি খুবই দুঃখজনক। এসব বিষয় বন্ধ করার জন্য সরকারের তরফ থেকে ইতিমধ্যে একটা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যাতে করে যাচাই-বাছাই না করে তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে গ্রেপ্তার না করা হয়। 

পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, সব গণহত্যা মামলার তদন্ত চলছে। আমরা তদন্তগুলো খুব মনযোগ দিয়ে করি যাতে তদন্ত নিখুঁত হয়। এতে করে সময় এক বছর বা দেড় বছর লাগুক এতে সমস্যা নাই। তবে তদন্ত রিপোর্ট যেন কোর্টে গিয়ে ফেল না করে। এটা হলো আমার টার্গেট। কিছু একটা লিখে জমা দেয়া আমার টার্গেট না। আসামি গ্রেপ্তার নিয়ে বলেন, আমরা চাই প্রকৃত আসামি গ্রেপ্তার। হাজার হাজার আসামি আমরা গ্রেপ্তার করি না। কিন্তু আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও গ্রেপ্তার বাণিজ্য হয়ে যাচ্ছে। নানা পন্থায় সেগুলো হচ্ছে। পুলিশেরও কিছু অসৎ লোক জড়িত আছে। তবে আমরা প্রকৃত আসামি গ্রেপ্তার করছি। 

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত সপ্তাহে বলেছিলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হওয়া মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রমে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কয়েকটি মামলায় চার্জশিটও দেয়া হয়েছে। তবে তদন্তে কিছু জটিলতা ছিল, বিশেষ করে আসামির সংখ্যা নিয়ে। কোনো ঘটনায় যেখানে ২০ জন আসামি হওয়ার কথা, সেখানে ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এতে নির্দোষ অনেকেই মামলায় জড়িয়ে গেছেন। ফলে তদন্তে কিছুটা সময় লাগছে। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে সব মামলার চার্জশিট সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হবে।