Image description

মুঠোফোনে অস্ত্রধারীদের ভিডিও করায় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন (৩৮)কে কুপিয়ে হত্যা করেছে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা। বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে গাজীপুর নগরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তারা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এক ব্যক্তিকে ধাওয়া করছিল। সাংবাদিক তুহিন সেই দৃশ্য মুঠোফোনে ভিডিও করছিলেন। তখন তাকে ধাওয়া করে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থলের একটি দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে এ তথ্য জানিয়েছে পুলিশ। এ ঘটনায় পাঁচজনকে আটক করেছে পুলিশ। কিন্তু অস্ত্রধারী ঘাতকদের কেউই গ্রেপ্তার হয়নি। তুহিন দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতেন। 

হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার রবিউল হাসান বলেন, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যার আগমুহূর্তের কিছু দৃশ্য সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায়, চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা ধারালো দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এক ব্যক্তিকে ধাওয়া করছে। পেছন থেকে সেই দৃশ্য ভিডিও করছিলেন তুহিন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এই দৃশ্য ভিডিও করায় তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৮ মিনিট। ঘটনাস্থল চান্দনা চৌরাস্তা মসজিদ মার্কেটের পশ্চিম পাশে। কালো রঙের জামা পরা এক নারী হেঁটে যাচ্ছেন। পেছন দিক থেকে নীল রঙের জামা পরা এক ব্যক্তি ওই নারীকে পেছন দিক থেকে টেনে ধরেন। ওই নারী জোর করে চলে যেতে চাইলে তার সামনে গিয়ে গতি রোধ করেন ওই ব্যক্তি। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি নারীকে চড়-থাপ্পড় মারেন। ঠিক এমন সময় পাশ থেকে ধারালো অস্ত্র হাতে কয়েক যুবক ওই ব্যক্তিকে কোপানোর চেষ্টা করেন। নীল শার্ট পরা ওই ব্যক্তি দৌড়ে পালিয়ে যান।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা: এ ঘটনার কিছু সময় আগে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি দোকানে বসে ছিলেন সাংবাদিক আসাদুজ্জামান ও তার সহকর্মী শামীম হোসেন। এ বিষয়ে সাংবাদিক শামীম হোসেন বলেন, চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় আমরা দু’জন একদিক থেকে অন্য পাশে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ঠিক এ সময় একজন নারী ও পুরুষ আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যান। কয়েকজন লোক দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে বলতে থাকে, ‘এই পাইছি, তোরা আয়।’ এ সময় ওই ব্যক্তি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাকে ধাওয়া করে। তখন তুহিন মুঠোফোন বের করে তাদের পেছনে দৌড় দেন। পরে আমি তুহিনকে খুঁজতে এগিয়ে যাই। অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা হঠাৎ থেমে গিয়ে পেছনে তাকায়। তুহিন তখন দৌড়ে চায়ের দোকানে ঢুকে যায়। ঠিক ওই মুহূর্তে ওরাও চায়ের দোকানে ঢুকে ওকে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়। আমি চৌরাস্তা এলাকায় পুলিশের গাড়ি খুঁজতে থাকি। কোনো গাড়ি দেখতে না পেয়ে বাসন থানার ওসিকে ফোন করি। কিছু সময় পর পুলিশ আসে।

সিসিটিভি ফুটেজে নারীর সঙ্গে যে ব্যক্তির ধস্তাধস্তি হয়েছিল পরে তিনি পালিয়ে যান। ওই ব্যক্তি আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তার নাম বাদশা মিয়া। তিনি বলেন, ওই মেয়েসহ একটা টিম আছে। ওরা আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেছে। পুলিশ জানায়, গাজীপুর নগরের বাসন, ভোগরা ও চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি চক্র আছে; যারা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। সিসিটিভি’র ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে, তারা সবাই ছিনতাইকারী দলের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। ভিডিওতে যে নারীকে দেখা গেছে, তিনিও ওই চক্রের সদস্য হতে পারেন। চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে ওই চক্র ছিনতাই করে থাকে। 

হত্যার ঘটনায় মামলা
এদিকে, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। গতকাল সকালে নিহতের বড় ভাই মো. সেলিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে বাসন থানায় মামলাটি করেন। হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন হিসেবে পাঁচজনকে আটক করেছে পুলিশ। তবে সিসিটিভি ফুটেজে অস্ত্র হাতে যাদের দেখা গেছে, তাদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে বাসন থানার ওসি শাহীন খান বলেন, আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। অপরাধে জড়িত প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হবে। 

দাফন সম্পন্ন
গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায় বাদ জুমা তুহিনের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি নিয়ে আসা হয়। মাগরিবের নামাজের পর দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। 

হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন
সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও সভা হয়েছে। গতকাল সকালে গাজীপুর প্রেস ক্লাবের সামনে এই কর্মসূচির আয়োজন করে সাংবাদিক ইউনিয়ন। কর্মরত সাংবাদিকরা হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান। গাজীপুর সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন- সাংবাদিক ফজলুল হক মোড়ল, ফারদিন ফেরদৌস, মাসুদ রানা, মাজহারুল ইসলাম, মাহমুদা শিকদার প্রমুখ।

গ্রামের বাড়িতে আহাজারি
ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানান, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের মো. হাসান জামাল ও সাবিহা খাতুন দম্পতির ছেলে। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তুহিন সবার ছোট। তার স্ত্রীর নাম মুক্তা আক্তার। তাদের সংসারে দুই ছেলে রয়েছে। বড় ছেলের নাম তৌকির (৭) ও ছোট ছেলের নাম ফাহিম (৩)। তুহিনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সকাল থেকেই আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা তার গ্রামের বাড়ি ভাটিপাড়া আসতে শুরু করে। শুক্রবার বেলা ১২টার দিকে ভাটিপাড়া গ্রামে গিয়ে এমন চিত্র দেখা যায়। এ ঘটনায় গ্রামের বাড়িতে চলছে আহাজারি। ছেলের এমন মৃত্যুর খবরে পাগলপ্রায় বৃদ্ধ বাবা মো. হাসান জামাল। ক্ষণে ক্ষণেই মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি। বুক চাপরে আহাজারি করছিলেন ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা মা সাবিহা খাতুন। তিনি বলছিলেন, ‘আমার ছেলে বলেছিল, আমি তোমাকে আগামী মাসে চোখের ডাক্তার দেখাবো। ডাক্তার অপারেশন করানোর কথা বললে, অপারেশন করাবো। আম্মা কোনো চিন্তা করো না। তুমি ভালো হয়ে যাবে।’ 

শেষ স্ট্যাটাসে যা লিখেছিলেন তুহিন
সন্ত্রাসীদের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগের দিন নিজের ফেসবুকে একটি প্রতিবাদী স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন সাংবাদিক তুহিন। তিনি লিখেছিলেন, ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে আগে কইতো- রাজাকার এখন কয় - স্বৈরাচার আর জামাতের বিরুদ্ধে বললে শাহবাগী, ৭১ আর ২৪ এর বেচাবিক্রিতে আমজনতার জুস বের হয়ে যাচ্ছে।’