Image description

বাংলাদেশের আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর যে ঘোষণা দিয়েছেন—সব জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ও ওসিদের লটারির মাধ্যমে বদলি করা হবে—তা নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এমন সিদ্ধান্ত থেকে নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা, একতরফা পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ঠেকানো, এবং জনগণের চোখে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি সদিচ্ছা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। 

এই ঘোষণায় একটি প্রগতিশীল মানসিকতা ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা লক্ষ করা যায়, যেখানে সরকার চায় নির্বাচনকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিরপেক্ষ ও অবিচল হোক। লটারি পদ্ধতির মাধ্যমে বদলির সিদ্ধান্ত প্রশাসনের ভেতরে ‘ক্ষমতার ভারসাম্য’ রক্ষার একধরনের কৌশল বলেই ধরা যায়। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে প্রশাসনিক কাঠামোকে মুক্ত রাখা, বিশেষ করে নির্বাচনী সময়ে, গণতন্ত্রের স্বার্থেই জরুরি।

নির্বাচনের আগে লটারির মাধ্যমে সব এসপি ও ওসি বদলির সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের একটি ব্যতিক্রমী প্রয়াস। তবে এতে কর্মকর্তাদের জেলার ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞতা, প্রশাসনিক সমন্বয়ের ঘাটতি, এবং হঠাৎ পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার ঝুঁকি থেকেই যায়। এই প্রক্রিয়া সফল করতে হলে শুধু লটারি নয়, কর্মকর্তার অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও স্থানভিত্তিক বাস্তবতাও সমান গুরুত্বে বিবেচনায় নিতে হবে, নইলে এ সিদ্ধান্ত কার্যকারিতা হারাতে পারে। তবে এই অভিনব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে রয়েছে কিছু মৌলিক চ্যালেঞ্জ, সীমাবদ্ধতা ও প্রশ্ন, যেগুলোর জবাব খোঁজা জরুরি—

১. নিরাপত্তা বিশ্লেষণে অঞ্চলভিত্তিক অভিজ্ঞতা অপরিহার্য

একজন অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তা যখন কোনো থানায় দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেন, তখন তিনি সেই এলাকার সামাজিক পরিবেশ, অপরাধপ্রবণ এলাকা, রাজনৈতিক বাস্তবতা, প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও স্থানীয় সমাজ কাঠামো সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট, বাস্তবভিত্তিক ধারণা গড়ে তোলেন। তার অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এলাকার স্বাভাবিক গতিবিধির একটি মানচিত্র তার মনে গড়ে ওঠে।

গোয়েন্দা কার্যক্রমের একটি মৌলিক নীতি হলো—“স্বাভাবিকের অনুপস্থিতি এবং অস্বাভাবিকের উপস্থিতি শনাক্ত করা।” এই নীতি তখনই কার্যকর হয়, যখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানেন, কোন ঘটনাগুলো তার দায়িত্বাধীন এলাকায় স্বাভাবিক এবং কোনগুলো অস্বাভাবিক। কিন্তু যখন একজন কর্মকর্তা হঠাৎ করে একেবারে অপরিচিত কোনো থানায় বদলি হয়ে আসেন, তখন এই পার্থক্য অনুধাবনে সময় লাগে। নতুন পরিবেশ বুঝে ওঠার আগেই অপরাধী চক্র নিজেদের অবস্থান মজবুত করে ফেলার সুযোগ পায়, এবং আইনশৃঙ্খলার ফাঁকফোকর ব্যবহার করে বিশৃঙ্খলা বা নাশকতা সৃষ্টি করতে পারে। ফলে এলাকা সম্পর্কে পূর্বপরিচয় ও বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া নিরাপদ নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং কার্যকর আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

২. অতিরিক্ত দায়িত্ব, সীমিত শক্তি: কঠিন বাস্তবতা

বাংলাদেশের প্রতিটি থানায় গড়ে ৩-৪ লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে, যা একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। অথচ একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) অধীনে থাকা পুলিশের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত সীমিত। এই স্বল্পসংখ্যক জনবল দিয়ে পুরো এলাকার অপরাধ প্রতিরোধ, গোয়েন্দা তৎপরতা, জনগণের অভিযোগ গ্রহণ ও তা যাচাই-বাছাইসহ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন। এই বাস্তবতায় যদি একজন নতুন ওসি দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যিনি সংশ্লিষ্ট এলাকা সম্পর্কে অপরিচিত, তাহলে সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠবে। তিনি এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে কে প্রকৃত অভিযোগকারী, কে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং কে ভেতরে ভেতরে অপরাধ চক্রের সঙ্গে যুক্ত—তা চিহ্নিত করতে হিমশিম খেতে পারেন। বিভ্রান্তির সুযোগে স্থানীয় দুষ্টচক্র বা স্বার্থান্বেষীরা তাকে ভুল তথ্য দিয়ে পরিচালিত করতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে জনসংখ্যা ও পুলিশি জনবলের মধ্যকার বৈষম্য এবং অপরিচিত কর্মকর্তার বাস্তবতা—উভয়ই আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। যা সুষ্ঠু নির্বাচন এবং নিরাপদ সমাজব্যবস্থার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।

৩. সোর্স ঘাটতি ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের ভাঙন: মাঠের বাস্তব চ্যালেঞ্জ

পুলিশিংয়ের সফলতা অনেকাংশেই নির্ভর করে ‘সোর্স নেটওয়ার্ক’ বা তথ্যদাতাদের উপর। প্রতিটি থানায় কিছু নির্ভরযোগ্য স্থানীয় সোর্স গড়ে ওঠে, যারা অপরাধীদের গতিবিধি, সন্দেহজনক কার্যকলাপ ও এলাকায় উদ্ভূত যেকোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহ করে। তবে এই ধরনের সোর্স হঠাৎ করে গড়ে ওঠে না—এটি তৈরি হয় দীর্ঘদিনের বিশ্বাস, আস্থাভাজন সম্পর্ক এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে।

ফলে একজন নতুন ওসির পক্ষে কয়েক দিনের মধ্যে এমন একটি কার্যকর ও বিশ্বাসযোগ্য সোর্স নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। তিনি হয়তো স্থানীয় জনমানস, অপরাধচক্রের ধরন কিংবা রাজনৈতিক পরিবেশ সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা না রেখেই দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হন। এর ফলে নির্বাচনকালীন সময়ে গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতি দেখা দেয়, অপরাধী শনাক্তকরণে দুর্বলতা তৈরি হয়, এবং সহিংসতা বা নাশকতার পূর্বাভাস না থাকায় হঠাৎ করে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে।

এই বাস্তবতা নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে এবং গোটা প্রশাসনিক কাঠামোকে দুর্বল করে দিতে পারে। তাই থানায় নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তার পূর্বপরিচিতি ও স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

৪. এলাকার বৈশিষ্ট্য, অপরাধ প্রবণতা ও মানুষের আচরণ না জানা: একটি বড় চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের প্রতিটি থানা বা জেলা তার নিজস্ব ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠেছে। কোথাও চাঁদাবাজি প্রধান সমস্যা, কোথাও মাদক ব্যবসা, আবার কোথাও রাজনৈতিক সহিংসতা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

একজন অভিজ্ঞ ও স্থানীয় বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত অফিসার সহজেই বুঝতে পারেন—কোন সমস্যার মোকাবেলায় কীভাবে এগোতে হবে, কার সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে, কোথায় বেশি নজরদারি দরকার। কিন্তু একজন নতুন অফিসার যখন ওই এলাকার কোনো পূর্বপরিচয় বা বোঝাপড়া ছাড়াই দায়িত্ব নেন, তখন বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করতে সময় লাগে।

এই সময়ের মধ্যেই অপরাধীরা সংগঠিত হয়ে ওঠে, সুযোগ খোঁজে, এবং নির্বাচনী সহিংসতা বা নাশকতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ফলে, এলাকায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও নিরাপদ নির্বাচন নিশ্চিত করা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।

৫. নির্বাচনী দায়িত্বের পাশাপাশি পুলিশের সাধারণ কার্যক্রম

নির্বাচনের সময় পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব অনেকগুণ বেড়ে যায়। তাদেরকে নির্বাচনকালীন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হয়, ভোট প্রচারণার সময়ে সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকতে হয়, ব্যালট বাক্স ও ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয় এবং ভোটারদের নিরাপদ পরিবেশে ভোট দেয়ার সুযোগ সৃষ্টিতে সহায়তা করতে হয়। এর সঙ্গে জরুরি মুহূর্তে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্বও থাকে।

এ সব কাজের পাশাপাশি পুলিশের দৈনন্দিন দায়িত্ব যেমন অপরাধ তদন্ত, সাধারণ ডায়েরি গ্রহণ, সামাজিক ও পারিবারিক সংঘাত নিরসন এবং নাগরিক সেবা প্রদান অব্যাহত থাকে। অর্থাৎ, নির্বাচনকালীন সময়ে তাদের দ্বৈত ও চাপপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়।

এই ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে এলাকার ভৌগোলিক ও সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা এবং যথেষ্ট অভিজ্ঞতা থাকা জরুরি। কিন্তু লটারির মাধ্যমে একেবারে অপরিচিত কোনো এলাকায় দায়িত্ব নেওয়া একজন কর্মকর্তার পক্ষে এসব কার্যক্রম সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দুর্বলতা দেখা দিবে এবং নির্বাচনের সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। 

৬. ডিসি বনাম এসপি/ওসির দায়িত্ব ও বদলির ভিন্নতা

জেলা প্রশাসক (ডিসি) একজন উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন এবং নির্বাচনকালীন সময়ে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের কাজ মূলত নীতিনির্ধারণ, ব্যবস্থাপনা ও বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় সাধনে কেন্দ্রীভূত। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে ডিসির বদলি লটারির মাধ্যমে করা কিছুটা যৌক্তিক মনে হতে পারে, কারণ তাদের ভূমিকা তুলনামূলকভাবে পরিকল্পনামূলক ও শৃঙ্খলাবদ্ধ।

অন্যদিকে, পুলিশের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে মাঠকেন্দ্রিক, ঝুঁকিপূর্ণ এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নির্ভর। একজন পুলিশ সুপার বা ওসির ভুল সিদ্ধান্ত এক মুহূর্তেই সহিংসতা সৃষ্টি করতে পারে বা প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাদের কাজ শুধু পরিকল্পনা নয়, বরং বাস্তব সময়ের ঘটনাগুলোকে বুঝে দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল।

তাই পুলিশের বদলি কেবল লটারির মাধ্যমে এলাকা বিবেচনা না করেই করলে তা নীতিগত ও কার্যকর প্রশাসনের জন্য অশুভ হতে পারে। এতে দক্ষতা, স্থানীয় বাস্তবতা অনুধাবনের ক্ষমতা ও জবাবদিহিতার অভাব দেখা দিতে পারে, যা সরাসরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

অতএব, ডিসি ও পুলিশের দায়িত্ব ও প্রকৃতির এই মৌলিক পার্থক্য বোঝা অত্যন্ত জরুরি, যাতে বদলির ক্ষেত্রে যথাযথ নীতি গ্রহণ করে প্রশাসনিক কার্যক্ষমতা বজায় রাখা যায় এবং নির্বাচনী সময় নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

৭. আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অপরিহার্য হাতিয়ার: কমিউনিটি পুলিশিং ভেঙে পড়বে

আজকের পুলিশিং শুধুমাত্র থানার চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং কমিউনিটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সহযোগিতা এখন পুলিশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম। একজন অভিজ্ঞ ওসি স্থানীয় ইউপি সদস্য, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ইমাম ও এনজিও প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যা সহিংসতার ঝুঁকি আগেভাগেই শনাক্ত ও প্রতিরোধে সাহায্য করে। 

কিন্তু নতুন একজন কর্মকর্তার পক্ষে এই ধরনের বিশ্বাসভিত্তিক সামাজিক নেটওয়ার্ক দ্রুত গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। এর ফলে পুলিশিং হয়ে পড়বে বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল, এবং সহিংসতা বা অপরাধের বিরুদ্ধে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে তারা ব্যর্থ হবেন। ফলে নির্বাচনী সময় নিরাপত্তা রক্ষা ও সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।  

৮. পুলিশের ভুল চিত্রায়ন বনাম বাস্তব অবদান

সিনেমা, নাটক বা জনমত গঠনের নানা মাধ্যমেই প্রায়শই পুলিশকে দুর্নীতিপরায়ণ, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কিংবা দলদাস চরিত্রে তুলে ধরা হয়। এর ফলে সমাজে পুলিশের প্রতি একধরনের নেতিবাচক মানসিকতা গড়ে ওঠে। মানুষ ভুলে যায়—এই পুলিশই প্রতিদিন অপরাধ রোধে মাঠে কাজ করে, নারী ও শিশুদের সুরক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, দুর্যোগে উদ্ধার কাজে অগ্রগামী ভূমিকা রাখে এবং সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা প্রতিরোধে জীবন বাজি রাখে।

এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক পুলিশ সদস্য প্রাণ হারান, পরিবার থেকে দূরে থাকেন, অসহনীয় পরিবেশে রাতদিন কাজ করেন। অথচ তাদের অবদান অনেক সময়ই দৃশ্যমান হয় না বা স্বীকৃতি পায় না।

এই বাস্তবতা অনুধাবন না করে, যদি শুধুমাত্র "নির্বাচনের নিরপেক্ষতা" রক্ষার যুক্তিতে পুলিশের বদলি লটারির মাধ্যমে নির্বিচারে করা হয়, তবে তা তাদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং মনোবল—সবকিছুকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে। পুলিশের কাজ কাগজে কলমে নয়, বরং সরাসরি মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—যেখানে বুদ্ধিমত্তা, মাঠজ্ঞান এবং মানসিক প্রস্তুতি অত্যন্ত জরুরি। সুতরাং, তাদের বদলি নীতিতে সতর্কতা ও বাস্তববোধ থাকা আবশ্যক।

৯. পুলিশহীন অবস্থা: জাতীয়তাবোধ ও বাস্তবতার সংমিশ্রণ

২০২৪ সালের ৫ থেকে ১৫ আগস্ট, দেশের নানা অঞ্চলে পুলিশের কার্যক্রম কার্যত থমকে গিয়েছিল। এই সময়টায় আশ্চর্যজনকভাবে মানুষ নিজেরাই শান্তি বজায় রেখেছিল, সহনশীলতা দেখিয়েছিল এবং আইন-শৃঙ্খলা ধরে রেখেছিল। এটি নিঃসন্দেহে ছিল এক ব্যতিক্রমী মুহূর্ত—জাতীয়তাবোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

তবে এই ঘটনা থেকে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না যে, দেশের সব প্রেক্ষাপটেই জনগণ নিজেরাই আইন রক্ষা করবে। সবসময় মানুষের মধ্যে সেই সংযম বা সংহতির মনোভাব নাও থাকতে পারে—বিশেষ করে যখন পরিস্থিতি থাকবে উত্তপ্ত, রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত, বা চক্রান্তমূলক। তাই পুলিশের সক্রিয় উপস্থিতি ও পেশাদার তৎপরতা কখনোই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে না। বরং এমন অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য আরও সুসংগঠিত ও দক্ষ নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। নির্বাচনী সময়ে নতুন ওসি অনেক জটিল ও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন।

১০. নির্বাচনই সব নয়—রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভারসাম্য জরুরি

দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন না হওয়ায় দেশে এক ধরনের ‘নির্বাচনী ক্ষুধা’ তৈরি হয়েছে, যা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ক্ষুধা মেটাতে গিয়ে যদি রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো—বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, পুলিশ প্রশাসনের দক্ষতা ও জনগণের নিরাপত্তা—উপেক্ষিত হয়, তাহলে তা পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে।

নির্বাচন নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের প্রাণ, তবে সেটিকে কেন্দ্র করে যদি প্রশাসনিক ভারসাম্য নষ্ট হয়, যদি অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের এলাকা ছাড়া করে কেবল নিয়ম রক্ষার জন্য দায়িত্ব ভাগ করা হয়, তাহলে তা রাষ্ট্র পরিচালনায় স্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একটি সফল নির্বাচন মানে কেবল ভোট গ্রহণ নয়—বরং একটি সুরক্ষিত, স্থিতিশীল ও বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করাও। কাজেই, নির্বাচনকে গুরুত্ব দিতে হবে—কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে একটি ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে।

করনীয় কি? 

বাংলাদেশে মোট থানার সংখ্যার তুলনায় ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংখ্যা অনেক গুণ বেশি, তাই আমাদের হাতে অনেক বিকল্প রয়েছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে সব ইন্সপেক্টর থানার দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্য নন, তবে যোগ্য কর্মকর্তার অভাবও নেই। এখন উচিত তুলনামূলকভাবে সৎ, যোগ্য ও অভিজ্ঞ — এবং অবশ্যই ফ্যাসিবাদী পণ্য নন — এমন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে যাঁরা সংশ্লিষ্ট এলাকাটি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত, তাঁদেরকেই দায়িত্ব প্রদান করা। সঙ্গে যদি কঠোর মনিটরিং রাখা যায়, তাহলে লটারির তুলনায় অনেক ভালো ফল দিতে পারবে।

উপসংহার:

লটারিভিত্তিক বদলির সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সদিচ্ছার একটি প্রকাশ, যা প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তির ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত যত মহৎই হোক, তা যদি মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা, পুলিশের কার্যপ্রবাহ এবং প্রশাসনিক জটিলতা বিবেচনায় না রেখে বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে তার ফলাফল হতে পারে উল্টো।

আমরা সবাই চাই একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচন। কিন্তু সেই নির্বাচন সফল করতে হলে চাই দক্ষ, অভিজ্ঞ ও এলাকার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানেন এমন পুলিশ প্রশাসন—যারা মুহূর্তের সংকটে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

আমি বলছি না এই ব্যবস্থা খারাপ হবে। তবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে যদি ওপরের সব দিক বিশ্লেষণ করে, প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও ভারসাম্য নিশ্চিত করে এগোনো যায়—তবে সেটাই হবে প্রকৃত রাষ্ট্রদর্শিতা।

"একটি সিদ্ধান্ত কেবল তার ঘোষণায় নয়, সফল হয় তার বাস্তবতায়—যেখানে চিন্তা, বিশ্লেষণ ও প্রস্তুতির ছাপ থাকে স্পষ্ট।"