
আয়নাঘর। প্রাথমিক দৃষ্টিতে মনে হবে চারদিকে আয়না পরিবেষ্টিত একটি ঘর। কয়েক বছর ধরে দেশে এটি সর্বাধিক আলোচিত শব্দ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে আলোচিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। আয়নাঘর শব্দটি মিশে আছে জোরপূর্বক গুমের সঙ্গে। এখন এটি শুধু গুমের একক কোনও প্রতীক নয়, বরং বাংলাদেশের মানবাধিকার সংকটের একটি আতঙ্কজনক চিহ্ন হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে গুমের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে যারা ফিরে এসেছেন, তারা জানিয়েছেন ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতার কথা। একটি অজানা, গোপন জায়গায় তাদের চোখ বেঁধে আটকে রাখা হয়েছিল দিনের পর দিন। যেখানে দিনের আলো প্রবেশ করে না, নীরবতা ঘিরে থাকে চারপাশে। এই ভয়ংকর জায়গাটির নাম হয়েছে আয়নাঘর।
‘আয়নাঘর’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয় একটি বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে। বাংলাদেশের গুমের শিকার ব্যক্তিদের নিয়ে করা একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর গোপন বন্দিশালাগুলোকে আয়নাঘর হিসেবে অভিহিত করা হয়। আভিধানিক ভাষায় যাকে বলা হয়- ‘সেফহাউজ’। যদিও এই আয়নাঘর সাধারণ কোনও থানার গারদ বা কারাগার নয়। এটি এমন এক জায়গা, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিচার বা আইনগত প্রক্রিয়ার কোনও অস্তিত্ব নেই।
বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকেই জোরপূর্বক গুমের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকে। বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, ছাত্রনেতা এমনকি ব্যবসায়ী- কেউই বাদ যাননি জোরপূর্বক অন্তর্ধান থেকে। বিভিন্ন গুমের ঘটনায় অনেকেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর ফিরে এলেও অনেকেই এখনও ফিরে আসেননি। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে- নিশ্চিত করে কেউ কিছুই বলতে পারেনি। তবে ধারণা করা হয়, তাদের কেউ আর জীবিত নেই। যেসব ভুক্তভোগী ফিরে এসেছেন, তারা জানিয়েছেন গোপন বন্দিশালা তথা আয়নাঘরের নির্মম ও কষ্টদায়ক জীবনের কথা।
বিভিন্ন সময়ে আয়নাঘর থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের নির্মম অভিজ্ঞতার কথা উঠে এসেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও। এমনকি গুম সংক্রান্ত কমিশনে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, আয়নাঘরে নেওয়ার আগে তাদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হতো, যেন তারা বুঝতে না পারেন, কোথায় আছেন। ছোট্ট একটি কক্ষে রাখা হতো তাদের, যেখানে স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করতেও কষ্ট হতো। সেটিও ছিল সিসিটিভি ক্যামেরার নজরদারির মধ্যে। কক্ষগুলোতে দিনের আলো প্রবেশ করতো না। কৃত্রিম আলো জ্বালানো থাকতো সারাক্ষণ। নিয়মিত খাবার দেওয়া হলেও তা ছিল পরিমাণে কম। কোনও কথা বলার সুযোগ থাকতো না এসব কক্ষে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় ভুক্তভোগীদের শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন হুমকি দেওয়া হতো।
গুম কমিশনের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কক্ষগুলো ছিল ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ। সেলে টয়লেট ব্যবহারের জন্য নিচু বিল্ট-ইন প্যান বসানো ছিল। তবে, মাঝে কোনও দেয়াল না থাকায় ভুক্তভোগীরা যখন শুয়ে থাকতেন, তখন তাদের শরীর প্রায়শই ওই প্যানের ওপরেই পড়ে থাকতো। যার ফলে তারা ময়লা, প্রস্রার ও বিষ্ঠার অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যে থাকতে বাধ্য হতেন।
একটি ‘আয়নাঘরের’ যাবতীয় প্রমাণসহ কাঠামো মুছে ফেলার চেষ্টা, ছবি: সংগৃহীতগুম কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের গুম করা হতো, অর্থাৎ তাদের আটকের কোনও আনুষ্ঠানিক রেকর্ড থাকতো না। এর ফলে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দায়মুক্তভাবে নির্যাতন চালাতে পারতো। পরবর্তীকালে জনসমক্ষে হাজির করার আগে নির্যাতনের চিহ্ন লুকাতে কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের ওষুধ বা মলম দেওয়া হতো, যাতে ক্ষতচিহ্ন সহজে নজরে না আসে। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের চিহ্ন মুছে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেই তাদের মুক্তি দেওয়া হতো।
৪৬ বছর বয়সী একজন পুরুষ, যিনি ২০১৫ সালে ডিজিএফআই, র্যাব-১০ ও র্যাব-২-এর আয়নাঘরে ৩৯১ দিন গুম ছিলেন। তিনি কমিশনকে জানিয়েছেন- ‘ঘুমাতে নিলে, একজন আইসা বলতেছে, এই ঘুমাইতেছেন কেন? মানে ঘুমাইতে দিতো না। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যাওয়ার পরে বালিশ সরাই ফেলতো। একদম শীতের মধ্যে কম্বল-বালিশ সব সরাই ফেলছে। আর এমনি শাস্তি দিতো। চেয়ার ছাড়া (খালি পায়ের ওপর ভর দিয়ে) বসায় রাখতো। আবার দেখা গেছে, হ্যান্ডকাফ পরায়ে বিছানার পাশে আটকে দিয়ে রাখতো। তা আমার এই মশা হাইলে আমি তো মারতে পারতাম না। মশা কামড়াইতো। তো কষ্ট পাইতাম আর কী। এরকম শাস্তি দিছে আর কী।’
গুম ও গোপন বন্দিশালা বাংলাদেশের ভয়ের সংস্কৃতিকে আরও গভীর করেছে। নাগরিকরা জানতেন না, কখন কাকে তুলে নেওয়া হবে এবং তিনি আর ফিরে আসবেন কিনা? যদিও সরকার কখনোই কোনও গোপন কারাগারের অস্তিত্ব স্বীকার করেনি। কিন্তু গুম থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের ভাষ্যে কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় আয়নাঘর তৈরি করা হয়েছিল বলে উঠে এসেছে। এর মধ্যে ডিজিএফআই ভবনের পাশের একটি ভবন, র্যাব সদর দফতর, র্যাব-১ কার্যালয়, সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকা এবং বনানী, গুলশান, মিরপুর ও আশপাশের এলাকায় অনেক ভবনের নিচতলা বা বেজমেন্ট আয়নাঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গুমের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো- এতে আইনি সুরক্ষার কোনও সুযোগ নেই। পরিবার জানে না প্রিয়জন কোথায়, আইনজীবীরা আদালতে কিছু করতে পারেননি এবং খোঁজাখুঁজি করলেও বেশিরভাগ সময় পুলিশের কাছ থেকে সহায়তা মিলতো না। ‘আয়নাঘর’ রাষ্ট্রীয় সহিংসতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল, যেখানে মানুষের ন্যূনতম অধিকার পর্যন্ত পদদলিত হয়েছে। গুম, নির্যাতন এবং ভয় দেখানোর মাধ্যমে একটি ‘নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি’ গড়ে তোলা হয়েছিল। যেখানে রাষ্ট্র নিজের নাগরিকদের প্রতি দায়বদ্ধ ছিল না।
মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, এ ধরনের অভিযোগের তদন্ত হওয়া উচিত স্বাধীন ও আন্তর্জাতিক মানের তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে। আর গুমের শিকার মানুষদের ফিরে আসার পর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই রক্ষা পেতে পারে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার।