
মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায়, অভিযানকালে বাসা-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পাওয়া টাকা পয়সা ও মূল্যবান সামগ্রী আত্মসাৎ, অভিযানের আগাম তথ্য মাদক ব্যবসাযীদের কাছে ফাঁস করা, আবার নিজেরাই মাদক সেবনে যুক্ত থাকা, অভিযানকালে সাধারণ মানুষকে মাদক দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় এমনকি সরাসরি ছিনতাইসহ মাদক মামলার আসামিদের পরিবারের নারী সদস্যদের হয়রানির অভিযোগও রয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। নিরীহদের অনেকেই ঝামেলার আশঙ্কায় কখনো অভিযোগ করতে উৎসাহিত হন না। এর পরেও মাঠ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তদন্ত টিম।
গত এক মাসে অনেকের বিরুদ্ধে নেয়া হয়েছে বিভাগীয় সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। কারো কারো কাছে অভিযোগের ব্যাখা চাওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ১১ জনকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একজনকে পাঠানো হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসরে। এসব কর্মকর্তার বেশিরভাগই পরিদর্শক ও সহকারী পরিদর্শক পদমর্যাদার। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মাদক বিক্রেতা’র বাসা থেকে আনা ব্যাংকের চেক মিলেছে একজন সহকারী পরিচালকের অফিসে। পরে তার অফিস সিলগালা করা হয়। তার বিরুদ্ধে বিচারের ফাইলটি এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্র মতে, গত ২২ জুন ইয়াবাসহ গাজীপুরের টঙ্গী সরকারি কলেজের সামনে থেকে মো. রমিজ উদ্দিন নামে এক মাদক বিক্রেতাকে আটক করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। পরে রমিজকে নিয়ে যাওয়া হয় তার ভাড়া বাসায়। সেখানে তল্লাশি করে দুটি পলিব্যাগে ১৫ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
রমিজের পরিবারের অভিযোগ, এ সময় বাসা থেকে মোটা অঙ্কের টাকার একটি ব্যাংক চেক নিয়ে আসেন মাদকের কর্মকর্তারা। মাদক উদ্ধারের এ ঘটনায় অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া সহকারী পরিচালক মারফিয়া আফরোজ বাদী হয়ে মামলা করেন। এজাহারে জব্দ তালিকায় আসামির কাছ থেকে ইয়াবা ও মুঠোফোন উদ্ধারের কথা উল্লেখ থাকলেও কোনো ব্যাংক চেক দেখানো হয়নি। বিষয়টি জানাজানি হলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঢাকার গেন্ডারিয়ার বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ে যান। ছুটির মধ্যেই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফোন করে ডেকে আনা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে মারফিয়া আফরোজ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার অফিসকক্ষের ড্রয়ার থেকে ওই চেক উদ্ধার করা হয়। পরে মারফিয়া আফরোজার অফিস কক্ষটি সিলগালা করা হয়। রমিজ উদ্দিনকে গ্রেফতার অভিযানে ছিলেন সহকারী পরিচালক মারফিয়া আফরোজের নেতৃত্বে গোয়েন্দা বিভাগের বিভিন্ন পদমর্যাদার আট কর্মকর্তা। এরা হলেন, পরিদর্শক শাহরিয়া শারমিন, উপ-পরিদর্শক আবদুল আল মামুন ও মো. জান্নাতুল ফেরদৌস, সহকারী উপ-পরিদর্শক মো. আতাউল হক, সিপাহি সোহেল রানা, আবদুর রহমান, সাইমুন হাসান খান ও মো. লুৎফর রহমান।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হাসান মারুফ সাক্ষরিত গত ২৪ জুলাইয়ের এক আদেশে শাহরিয়া শারমিন, আবদুল্লাহ আল মামুন, জান্নাতুল ফেরদৌস, আতাউল হক ও সোহেল রানাকে ওই তারিখ থেকে চাকুরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সহকারী পরিচালক মারফিয়া আফরোজের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিবেন বলে জানা গেছে।
এদিকে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে মাদকবিরোধী অভিযানে গিয়ে সাড়ে আট লাখ টাকা লুটের অভিযোগে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তিন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গত ৭ জুলাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক হাসান মারুফ স্বাক্ষরিত আদেশে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তারা হলেন- টাঙ্গাইল জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম, সহকারী উপ-পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান ও জিয়াউর রহমান। একই ঘটনায় গত ৯ জুলাই সহকারি উপ-পরিদর্শক শামীম আল আজাদকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
অভিযোগে ভুক্তভোগী বলেন, গত ১৮ জুন অধিদফতরের লোকজন অভিযান পরিচালনা করে কোনও মাদকদ্রব্য না পেয়ে তাদের গাড়ির তেল খরচের জন্য ২০ হাজার টাকা দাবি করেন। ১০ হাজার টাকার বেশি তিনি দিতে না চাইলে ৩ ঘণ্টার নাটকীয়ভাবে অভিযান চালিয়ে ১০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার দেখানো হয়। একপর্যায়ে তারা ঘরের আলমারির তালা খুলে সেখানে থাকা নগদ ছয় লাখ ৬৬ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। এ ছাড়া তার ছেলের ঘর থেকেও নগদ এক লাখ ৮০ হাজার টাকা নেন। টাকা নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে, আমাকে ও আমার ছেলের স্ত্রীকে বিভিন্ন ভয়ভীতি ও হুমকি দেন। পরে জবানবন্দি ভিডিও রেকর্ড করা হয়।
এদিকে বহুল সমালোচিত এবং নারী নিয়ে মাদক সেবনরত অবস্থার ভিডিও ভাইরাল হওয়া সহকারী পরিচালক বাবুল সরকারকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তিনি গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গাজীপুর জেলা কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। এরপর তাকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়।
গত বছরের ১৫ নভেম্বর সিরাজগঞ্জে ইব্রাহিম খলিলের নেতৃত্বে উপ-পরিদর্শক মিনার পারভীনসহ কয়েকজন একটি অভিযানে যান। অভিযানকালে তারা রাস্তায় চলাচলরত প্রায়সবগুলো যানবাহন তল্লাশী করেন। কিন্তু কোনো মাদক উদ্ধার করতে পারেননি। ভোরে চেকপোষ্ট দিয়ে যাবার সময় এক জুয়েলারি ব্যবসায়ীকে আটক করে তার কাছ থেকে ২১ ভরি স্বর্ণালংকার ছিনতাই করা হয়। ওই অভিযানে সোর্সের গায়েও অধিদপ্তরের লোগো সম্বলিত কটি পরানো হয়। এ ঘটনায় অভিযানে থাকা মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরে সিরাজগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সিপাহী সোহেল রানার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মেলায় গত ২৮ জুলাই অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স্বাক্ষরিত আদেশে তাকে এক বছরের জন্য বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়। বড় অপরাধের জন্য এ ‘লঘুদ-’ নিয়েও ক্ষোভ বিরাজ করছে সকলের মনে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে সূত্র জানায়, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোঃ হাসান মারুফ। চাকুরিচ্যুত, বরখাস্ত এবং অধিনস্ত কর্মকর্তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, অপরাধ ও দুর্নীতির ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাবে, তদন্তে সত্যতা প্রমানে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে।