
মিথ্যা তথ্য দিয়ে রাজউকের ‘পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে’ প্লট নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে বরাদ্দ নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা রাজউকের প্লট বরাদ্দের জন্য কোনো আবেদন না করেই, শুধুমাত্র একটি নোটের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন রাজউক কূটনীতিক পাড়ার ৬০ কাঠার মূল্যবান জমি। ব্যাপক অনিয়ম সম্বলিত এসব বরাদ্দের নথিগুলো সংরক্ষিত থাকতো প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দীনের তত্ত্বাবধায়নে। কিন্তু ৫ই আগস্টের পরে নথির ৬টি অংশের মধ্যে ৫টি অংশ যথার্থভাবে সংরক্ষিত থাকলেও অংশ-২ টি সরিয়ে ফেলেন আসামিরা। ৫টি নথি উদ্ধার হওয়ায় এবং এসব নথির নোটাংশে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মোহাম্মদ সালাহউদ্দীনের স্বাক্ষর থাকায় তদন্ত করে আসামিদের মুখোমুখি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। গায়েব হওয়া নথির অংশ-২ এ মূলত শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তার পরিবারের দুর্নীতির মাধ্যমে প্লট বরাদ্দের তথ্য ছিল। ফলে প্লট বরাদ্দের জন্য বিভিন্ন চিঠি এবং উক্ত নথির সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি তদন্ত সংস্থার পক্ষে। এ ছাড়া নথিতে নোট উপস্থাপনকারী থেকে নোট অনুমোদনকারী পর্যন্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম, পদবি, ঠিকানা ও তাদের বর্তমান কর্মস্থল, ঠিকানা জানাও সম্ভব হয়নি।
দুর্নীতির এসব তথ্য গোপন করতে নিজে এবং অপরকে শাস্তি থেকে বাঁচাতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মোহাম্মদ সালাহউদ্দীন পরস্পর যোগসাজশে নথিগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ গায়েব করে দেন। এমনই চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে এসেছে দুদকের দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদনে।
রাজউক কর্তৃক পরিচালিত ‘পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে’ প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগের পৃথক ৬টি মামলায় শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের ৭ সদস্যসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে গত ৩১শে জুলাই অভিযোগ গঠন করেছেন আদালত। আগামী ১১ এবং ১৩ই আগস্ট মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছেন। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক আবদুল্লাহ আল মামুন ও ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক মো. রবিউল আলম এ আদেশ দেন। আইন অনুযায়ী প্লট বরাদ্দের জন্য নির্ধারিত ফরমে আবেদন না করেই ৬০ কাঠার ৬টি প্লট হাতিয়ে নেয়া, ঢাকা শহরে স্থায়ী আবাসন থাকা সত্ত্বেও হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট বরাদ্দ নেয়াসহ কয়েকটি অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক (ববি) এর বিরুদ্ধে বিচার কাজ চলছে। এসব অভিযোগে আরও ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। আসামিরা পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাজউক আবাসনের উদ্দেশ্য কোনো জমি নির্বাচন করলে, টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৩ এর ১৭৭ ধারা অনুযায়ী প্লট বরাদ্দের উদ্যোগ গ্রহণ করবে। আবার ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (এলোটমেন্ট) রুল, ১৯৬৯ অনুযায়ী রাজউকের চেয়ারম্যান সংবাদপত্রে আবাসন ও আবাসিক উদ্দেশ্য প্রাপ্যতা সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তি দিবেন। বিজ্ঞপ্তিতে বরাদ্দের জন্য উপলব্ধ জমির ধরন, আকার, আবেদন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকতে হবে। ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট রুলের ৪নং বিধি অনুযায়ী প্লট বরাদ্দের জন্য গঠিত ট্রাস্ট একটি আবেদন ফরম নির্ধারণ করবে। বিধি-৫ অনুযায়ী উক্ত ফরম ছাড়া অন্য কোনোভাবে আবেদন গ্রহণ করা যাবে না। বিধি-৬ অনুযায়ী আবেদনকারী ব্যক্তিদের নাম রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করবে এবং প্রকল্প উন্নয়ন ও পুনর্বাসনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কেউ আবেদন করলে পৃথক রেজিস্ট্রারে তা লিপিবদ্ধ করা হবে। বিধি-৯ অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তিকে কিংবা তার সন্তানাদিদের নামে রাজউক কোনো সরকারি হাউজিং এস্টেট অথবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে কোনো জমি বরাদ্দ দেয় কিংবা রাজউকের আওতাধীন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সিটির করপোরেশন, পৌরসভা, শহরতলীতে কোনো ব্যক্তির নামে কোনো বাড়ি থাকলে তাকে কোনো প্লট বরাদ্দ করা যাবে না। উক্ত বিধিতে আরও উল্লেখ আছে যে, আবেদনকারীকে প্রথমশ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা স্বাক্ষরিত একটি হলফনামা দাখিল করতে হবে। যাতে উল্লেখিত ব্যক্তিরা পূর্বে কোনো প্লট পায়নি মর্মে অঙ্গীকারবদ্ধ হবেন। নথিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, আসামি শেখ হাসিনা, রেহানা ও পরিবারের সদস্যরা রাজউকের প্লট বরাদ্দের জন্য রাজউকের ফরমে কোনো আবেদন না করেই হাতিয়ে নেন মূল্যবান এসব জমি।
প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাজউকের এখতিয়ারাধীন ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায় আসামি সজীব ওয়াজেদ জয়ের বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে। আসামির পিতা ওয়াজেদ মিয়ার ক্রয়সূত্রে বাড়িটি হাসিনা, জয় ও তার বোন পুতুল উত্তরাধিকারসূত্রে পান। যা শেখ হাসিনা তার প্রাপ্য ০.০৩ একর জমি তার ছেলে জয় ও কন্যা পুতুলকে হস্তান্তর করেন। অর্থাৎ আসামিদের নিজস্ব বাড়ি থাকা সত্ত্বেও হলফনামায় তথ্য গোপন করে রাজউকের প্লট হাতিয়ে নেন। শেখ হাসিনা তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে ২০২২ সালের ৩০শে আগস্ট ছেলে জয়ের জন্য বরাদ্দ করিয়ে নেন ১০ কাঠার একটি প্লট। নথিসমূহ (অংশ-১ থেকে অংশ-৬) পর্যন্ত বিধি-১৩ অনুযায়ী বিশেষ কোটায় প্রধামন্ত্রীর কার্যালয়ে খোলা হয়। এতে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দীন প্রস্তাব করতেন এবং শেখ হাসিনা তাতে স্বাক্ষর করতেন। একান্ত সচিব সালাউদ্দিন ৬টি নথি সংরক্ষণ করতেন।
দুর্নীতির এ মামলার তদন্তকালে গত ৬ই ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসব নথি চেয়ে পত্র দেয়া হয়। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নথির ৬টি অংশের মধ্যে থেকে শুধু ২নং অংশটি পাওয়া যায়নি। কারণ উদ্ঘাটনে ৩ সদস্যর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে তারা জানায়, গত ৫ই আগস্টের পরে কার্যালয়ের নথি ও নথি রেজিস্ট্রার, কম্পিউটারসহ অন্যান্য মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তদন্ত সংস্থার পক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু দুদকের তদন্ত বলছে, নথির অন্য অংশগুলো ঠিক থাকলেও শুধুমাত্র নথির অংশ-২ যেটিতে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তার পরিবারের দুর্নীতির মাধ্যমে অবধৈ প্লট বরাদ্দের প্রমাণাদি ছিল, সেটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া উদ্ধার করা বাকি ৫টি নথির নোটাংশে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দীনের স্বাক্ষর পাওয়া যায়। এদিকে গত ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নথি পোড়ানো, ধ্বংস হওয়া, নথি খোয়া যাওয়া সংক্রান্ত কোনো জিডি, ইনভেনটরি লিস্ট পরিদর্শন প্রতিবেদনে উক্ত আলামত অংশ-২ নথিটি অন্তর্ভুক্ত থাকার কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দীন পরস্পর যোগসাজশে নথিগুলোর বাকি অংশ রেখে শুধুমাত্র অংশ-২ গায়েব করে দেন।