
কিশোর গ্যাং এখন ভয়াবহ আতঙ্কের নাম। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে লিপ্ত তারা। গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এ সুযোগে আরও বেপরোয়া হয়ে পড়ে তারা। পাড়া-মহল্লায় প্রকাশ্যে দেশীয় অস্ত্র হাতে মহড়া, হামলা-মারধর, চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ে গ্যাংয়ের সদস্যরা। নিজ এলাকায় প্রভাব বাড়াতে একদল আরেক দলের সঙ্গে ভয়ংকর সংঘাতেও লিপ্ত হচ্ছে। তাদের অপরাধ ঠেকাতে রীতিমতো নাজেহাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন প্রয়োগ বা সংশোধনমূলক শাস্তি দিয়েই কিশোর গ্যাংয়ের বিস্তার ঠেকানো সম্ভব নয়। দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই অপরাধী দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চতুর্মুখী সমাধানের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এতে সাংস্কৃতিক চর্চা ও পারিবারিক বন্ধন জোরদারের মতো বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া প্রান্তিক পরিবারগুলোকে আর্থসামাজিক সহায়তা, সমাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দমনের মাধ্যমে কিশোর গ্যাং সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করতে হবে।
সবশেষ গত বছরের এপ্রিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে ২৩৭টির মতো কিশোর গ্যাং রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে ১২৭টি, যার সদস্য ১ হাজার ৩৮২ জন। চট্টগ্রামে রয়েছে ৫৭টি গ্যাংয়ে ৩১৬ জন। এর আগে ২০২২ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সারা দেশে অন্তত ১৭৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। রাজধানীতে রয়েছে ৬৬টি, চট্টগ্রাম শহরে ৫৭টি। তবে গত এক বছরের বেশি সময় বিস্তারিত তথ্যভান্ডার তৈরি হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে এসব অপরাধীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসান এ শাফী জানান, গ্যাং সদস্যরা সাধারণত এমন প্রান্তিক পরিবেশে বেড়ে ওঠে, যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক স্বীকৃতি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। এরই ধারাবাহিকতায় আত্মপরিচিতির সংকট থেকে তারা গ্যাং সংস্কৃতিকে বীরত্ব ও কর্তৃত্বপূর্ণ পুরুষত্বের প্রতীক মনে করে। তখন ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে গ্যাংস্টার সংস্কৃতি, র্যাপ মিউজিক, সহিংসতানির্ভর নায়কত্ব তরুণদের মধ্যে এক পরাবাস্তব কল্পনার জগৎ তৈরি করে। এতে সমাজ যখন কোথাও তাদের সম্মান দেয় না, তখন গ্যাং সংস্কৃতি বিকল্প আত্মপরিচয়ের পরিসর হয়ে দাঁড়ায়।
এ অধ্যাপক আরও জানান, দুর্বল সামাজিক সম্পর্ক ও ছিন্ন পরিবারব্যবস্থায় গ্যাংয়ের মাধ্যমে তারা যেখানে আনুগত্যের বিনিময়ে আর্থিক সহায়তা, ভ্রাতৃত্ব, সম্মান ও আবেগের নিরাপত্তা পায়। এতে তাদের কাছে সমাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়েও বেশি বাস্তব হয়ে উঠে। এছাড়া সহজলভ্যতার কারণে মাদকসেবনের মাধ্যমে একদিকে তাদের মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি ও আত্মবিশ্বাসের অনুভূতি জন্মায়, অন্যদিকে মাদক কারবারের মাধ্যমে তারা আর্থিক স্থিতিশীলতা পায়।
কিশোর গ্যাং বিস্তারের রাজনৈতিক প্রভাব প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, আমাদের দেশে রাজনীতিতে অপরাধীদের প্রয়োজন আছে। আবার অপরাধীদেরও রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন। এ দুই শক্তি যখন যতটুকু প্রয়োজন, এটা বিনিময় করে। আবার যখন ক্ষমতার পালাবদল হয়, তখন অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণের হাতও বদল হয়। রাজনৈতিক সংযোগের কারণে স্থায়ী রূপ পেয়েছে অপরাধী বা গ্যাং গ্রুপ।
তিনি আরও বলেন, এই গ্যাং সংস্কৃতির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বড় একটা অংশ হলো প্রান্তিক পর্যায়ের পরিবারের কিশোর। যারা শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা ও কর্মসংস্থানের মতো নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে অপরাধপ্রবণ হয়েছে। এই অপরাধপ্রবণতার ক্ষেত্রে দুইটি ধরন আমরা লক্ষ করছি। একটি হচ্ছে-তার বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে, আরেকটা হচ্ছে-অলস সময় বা কর্মহীন সময়কে পুঁজি করে কোনো পৃষ্ঠপোষক এদের দিয়ে গ্যাং তৈরি করে।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ঢাকা শহরে কিশোর অপরাধ প্রকট হয়ে উঠছে। এর অন্যতম কারণ কিশোর-কিশোরীদের সুস্থ বিনোদনের জায়গাগুলো যেমন: খেলার মাঠ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সামাজিকতা কম, মিডিয়ার ব্যবহার অত্যন্ত বেশি-ভিডিও গেম, ইন্টারনেটের মধ্যে তারা আসক্ত হয়ে পড়েছে। এতে পারিবারিক অনুশাসন, ধর্মীয় অনুশাসনের একটা অভাব দেখা দিচ্ছে। এসব কারণে তাদের মধ্যে অস্থিরতা এবং ধৈর্যধারণের সক্ষমতা কমে গেছে। এতে কিশোর গ্যাংগুলো সহজেই সক্রিয় হয়ে উঠছে এবং নানাভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, যারা কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে, তাদের মধ্যে একটা অংশ কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার নামক মানসিক রোগে ভুগছে।
অধ্যাপক হাসান এ শাফী জানান, কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি কোনো আলাদা সামাজিক গোষ্ঠীর সমস্যা নয়, বরং এটি সামগ্রিক সামাজিক কাঠামোর প্রতিফলন।
কয়েক দশক আগেও আমাদের পাড়া ও গ্রামভিত্তিক ক্লাব, নাট্যদল, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ছিল। সেখানে অংশগ্রহণের মাধমে তরুণদের সামাজিক নিরাপত্তা, মানসিক বিকাশ ও আত্মপরিচয় নির্মাণে ভূমিকা ছিল। বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থার দুর্বল দিক চিহ্নিত করে, অংশগ্রহণমূলক, মানবিক ও সমাজিক ন্যায় নিশ্চিতের মাধ্যমে এর দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব।
ড. তৌহিদুল হক বলেন, কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাষ্ট্রকে প্রো-অ্যাক্টিভ ভূমিকা পালন করা। অর্থাৎ, আগে থেকেই রাষ্ট্রকে এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে যে কোনো সামাজিক শ্রেণি কিশোর অপরাধের দিকে ধাবিত না হয়। তিনি বলেন, আমাদের দেশে যে কোনো ঘটনায় চটজলদি কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এটা লোকদেখানো ব্যবস্থা হিসাবে আমরা বিবেচনা করে থাকি। কিন্তু কিশোর অপরাধের মতো সমস্যা সমাধান করতে হলে বহুমুখী সমাধান প্রয়োজন। কর্মোপযোগী শিক্ষা অথবা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে একটা ন্যূনতম জীবনযাপনের সুযোগ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে সব ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, তাদের সরাসরি অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত না করে সংশোধনের উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য তিনটি গ্রুপের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। প্রথমত, পরিবারের। বাবা-মা শাসন করলেই যে তারা ভালো হয়ে যাবে, তা কিন্তু নয়। তার সঙ্গে গুণগত সময় দিয়ে বুঝিয়ে তার সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো স্কুল-কলেজে আসছে কি না, নজরদারি করা। তাদের মানবিক মূল্যবোধগুলো, অপরকে সম্মান করতে শেখানো। এছাড়াও রাষ্ট্র এ ধরনের কিশোর গ্যাংয়ে যারা আছে, তাদের ধরে সরাসরি শাস্তির আওতায় না এনে সংশোধন করতে হবে। সংশোধনাগারে শিশুদের পড়ালেখার পাশাপাশি তাদের সামাজিক দক্ষতার কৌশল শেখাতে হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা রোধে পুলিশকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যখনই কোনো এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নাম করে অপরাধের চেষ্টা করা হয়, তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে শুধু বাহিনীর পক্ষে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ সমস্যার সমাধানে পরিবার ও সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।