
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনের পতন হয়। সেই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি পালন করতে যাচ্ছে নতুন বাংলাদেশ। এ সময়ে ইতিহাস সৃষ্টি করা সংগঠনটির ‘সমন্বয়ক’দের চাঁদাবাজির খবর নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিকমাধ্যমে চলছে তীব্র সমালোচনা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি রেখে বাকি সব কমিটি স্থগিত করলেও এ বিতর্ক থামছেই না। গত এক বছরে বিভিন্ন সময় জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অনেক নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি বা অবৈধ আর্থিক লেনদেনসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ সামনে এসেছে। ফলে জুলাই বিপ্লব ম্লান হয়ে পড়ছে চাঁদাবাজির এ ধরনের ঘটনায়।
সবশেষ গত ২৬ জুলাই রাজধানীর গুলশানের ৮৩ নম্বর রোডে ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে পাঁচজন হাতেনাতে গ্রেপ্তার হন। আওয়ামী লীগের সাবেক এক এমপির বাড়ি থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা সাত দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। গ্রেপ্তাররা হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক কমিটির নেতা আবদুর রাজ্জাক রিয়াদ (বর্তমানে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য); বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা মহানগর শাখার আহ্বায়ক ইব্রাহিম হোসেন (মুন্না) এবং সদস্য মো. সাকাদাউন সিয়াম, সাদমান সাদাব ও আমিনুল ইসলাম।
জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নাখালপাড়ায় রিয়াদের ভাড়া বাসা থেকে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকার চেক জব্দের কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গতকাল বৃহস্পতিবার আবদুর রাজ্জাক বিন সোলাইমান ওরফে রিয়াদের আরেকটি ভাড়া বাসা (মেস) থেকে দুই লাখ ৯৮ হাজার টাকা জব্দের কথা জানিয়েছে গুলশান থানা পুলিশ।
এ ছাড়া সাকাদাউন সিয়াম ও সাদমান সাদাব আপন দুই ভাই। তারা রাজধানীর প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী, চলতেন টিউশনি করে। কয়েক মাস হলো টিউশনি ছেড়ে দিয়েছেন। নাটোরের গোপালপুরে আদি বাড়ি হলেও বর্তমানে রাজশাহীর বাসিন্দা তাদের পরিবার। বাবা এসএম কবিরুজ্জামান পেশায় গ্যাস ফিলিং স্টেশনের কর্মচারী। এ ঘটনায় এলাকায় চলছে তোলপাড়।
আবদুর রাজ্জাক রিয়াদের সঙ্গে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের থাকা ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে অনেককে সমালোচনা করতে দেখা যায়। আবার আবদুর রাজ্জাক রিয়াদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। চাঁদাবাজির এ ঘটনায় গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিকমাধ্যমে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
এ নিয়ে প্রকাশ্যেই বক্তব্য দিতে দেখা গেছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান পক্ষের অনেক নেতাকেও। ফলে জুলাই অভ্যুত্থানের বছর না পেরোতেই এসব কর্মকাণ্ড রাজনীতিতে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনায় গত রোববার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়া সারা দেশের সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।
দুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মারের বিরুদ্ধে অনুদানের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। তিনি গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জুলাই ৩৬, মুক্তির উৎসব’ কনসার্ট আয়োজনে ৭০ প্রতিষ্ঠানের কাছে ৭৬ লাখ টাকা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। আম্মার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের দেওয়া চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সালেহ হাসান নকীব সুপারিশও করেছেন। তবে বিষয়টি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ভাইরাল হয় এবং নানা আলোচনা-সমালোচনা চলে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মাহবুব উল্লাহ আমার দেশকে বলেন, গণমাধ্যমে যেসব খবর বেরিয়েছে, সেগুলো সত্য হলে তা অত্যন্ত দুঃখজনক, বেদনাদায়ক ও নিন্দনীয়। গণঅভ্যুত্থানের তরুণদের কাছ থেকে দেশ ও জাতি বড় ধরনের কিছু আশা করে। তারা চরিত্রগতভাবে নিষ্কলুষ থাকবে, এটাই সবার প্রত্যাশা। দেশে আমরা খারাপ মানুষ দেখতে দেখতে এতটাই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম যে, আর ভালো মানুষের দেখা পাব কি না সেটাও ভাবতে পারিনি। সে হতাশা কাটানোর সুযোগ এনেছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান। এতে জীবনবাজি রেখে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণরা অন্তত কক্ষচ্যুত না হোক, সেটাই সবার চাওয়া। বিভিন্ন দেশের বিপ্লবপরবর্তী পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, বুলেটের কাছে আত্মসমর্পণ না করা তরুণরা যেন এ ধরনের ঘটনায় না জড়ায়।
এর আগে চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে হাসপাতালে গিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে অবরুদ্ধ হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী মিশুসহ চারজন। পরে যৌথবাহিনী তাদের উদ্ধার করে চন্দ্রিমা থানায় নিয়ে যায়। তবে গোলাম কিবরিয়ার দাবি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ‘আওয়ামীপন্থিদের মব’-এর শিকার হয়েছেন তারা।
গত ৮ মার্চ রাজধানীর কলাবাগান থানার সমন্বয়ক পরিচয় দেওয়া সালাহউদ্দিন সালমানসহ ১৪ জনকে আটক করে যৌথবাহিনী। ১৯ মার্চ চট্টগ্রামে ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে দুজনকে আটক করে পুলিশে দেয় স্থানীয় লোকজন। তারা জাতীয় নাগরিক কমিটি, ইপিজেড থানা শাখার সদস্য বলে জানায় পুলিশ।
গত ২২ মার্চ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির পিরোজপুর জেলা প্রতিনিধি মুসাব্বির মাহমুদ সানি এবং তার সহযোগী মিলন শিকদারকে চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২৬ মার্চ বন্দরনগরী চট্টগ্রামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজির অভিযোগে ‘ছাত্র সমন্বয়ক’ পরিচয় দেওয়া দুজনকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন স্থানীয়রা। ডবলমুরিং থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, তারা চট্টগ্রামের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আটক দুজনের সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হয়েছেন।
১৮ এপ্রিল খুলনা নগরের এক বাড়িতে ঢুকে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্য ও সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে চার শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশে দেয় জনতা। ১৩ জুন সাতক্ষীরার দেবহাটায় ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে চাঁদাবাজির সময় তিন যুবককে আটক করে স্থানীয় জনতা। গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে চাঁদাবাজি, বালুমহাল দখলের অভিযোগ ওঠে একটি চক্রের বিরুদ্ধে।
সিলেটের সমন্বয়ক আসাদ উল্লাহ আল গালিব জানান, উপজেলায় তাদের কোনো কমিটি নেই। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে ক্যানসার রোগীর কথা বলে চাঁদা তুলতে গিয়ে তিনজন ভুয়া সমন্বয়ককে আটক করে সাধারণ জনতা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশ কয়েকজন সমন্বয়ক আমার দেশকে বলেছেন, এখনো জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর হয়নি। জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ এখনো দেওয়া হয়নি। এর মধ্যেই রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন নেতাদের চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এমনকি ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে এমন ঘটনা ঘটায় গর্ব করার মতো এই শব্দটি বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নেতাদের মর্যাদা যেমন ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, তেমনি জুলাই বিপ্লবের ভামমূর্তি ম্লান হচ্ছে।
তাদের মতে, গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অনেক নেতার বিরুদ্ধে কম-বেশি নানা অনিয়মে জড়ানোর খবর আসতে শুরু করে। গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে। তা নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে। সবশেষ গুলশানের ঘটনাটি ঘটল। এক বছরের মাথায় সংগঠনটির নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি দেওয়ার পর জুলাই মাসে রাজধানীতে এমন ঘটনা এবং এর ফলে কেন্দ্রীয় ছাড়া সারা দেশের কমিটি বিলুপ্ত করতে বাধ্য হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই সমালোচনা সামাজিকমাধ্যম থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনেও ছড়িয়েছে।
এ বিষয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ও এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব আমার দেশকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী নেতাদের এমন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া অবশ্যই জুলাই বিপ্লবের ভাবমূর্তি ম্লান করছে—এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এখানে তাদের মধ্যে যেমন বিভিন্ন দল, মত ও নানা আদর্শের ছাত্র আছে, তেমনই তাদের বিভিন্ন শক্তি বিভিন্নভাবে ব্যবহারও করছে। এ জন্য প্রাথমিকভাবে সংগঠনটি তাদের সারা দেশের কমিটি স্থগিত করেছে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অনেক আগেই বলেছেন, সমন্বয়ক পরিচয়টা এখন আর একজিস্ট করে না।
খোঁজ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী নেতাদের এমন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার পেছনে বড় যেসব কারণ জানা গেছে, তার মধ্যে রয়েছে— সারা দেশে নানা মত-পথ ও আদর্শের ছাত্রদের প্রথম ও দ্বিতীয় সমন্বয়ক কমিটিতে আসা, সময়স্বল্পতা ও সীমাবদ্ধতার জন্য পর্যাপ্ত যাচাই না করে কমিটি দেওয়া, বিজয়ী শক্তি হিসেবে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি হাসিল করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, জুলাই ছাত্রনেতাদের একটি বড় অংশের নতুন রাজনৈতিক দল গঠন, ডাকসুসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন্ন ছাত্র সংসদ নির্বাচন, নতুন করে সারা দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি দেওয়ার উদ্যোগে নেতৃত্বের বিরোধ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও শক্তির বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পাল্টা হিসেবে তাদের নেতাদের বিতর্কিত কাণ্ড গুরুত্ব পাওয়া। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং এর নেতৃত্বকে বিতর্কিত করতে এক বা একাধিক সংগঠিত দল ও সংস্থা কাজ করছে বলেও সূত্রের দাবি।
সম্প্রতি কমিটি স্থগিত ঘোষণার সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন সভাপতি রিফাত রশিদ বলেন, সারা দেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানার ব্যবহার করে নামে–বেনামে অনেক ধরনের অপকর্ম করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিভিন্ন রাজনৈতিক শেল্টারে বা বিপথগামী হয়ে চাঁদাবাজি-দুর্নীতিতে জড়িয়েছে অনেকে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই আমরা কেন্দ্রীয় কমিটি বাদে সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করছি।
এনসিপি নেতা আরিফুল ইসলাম আদীব আমার দেশকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একটি অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। এই সংগঠনে আন্দোলন-সংগঠন করা সাধারণ ছাত্ররাও ছিল। এর ফলে রাজনৈতিক সবগুলো দলই এখান থেকে সুবিধা নিতে চেয়েছে। বিদ্যমান ছাত্র সংগঠনগুলো থেকেও জেলাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটির সদস্য নেতৃত্ব পর্যায়ে রয়েছে। এখন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটি রয়েছে, তারা তাদের মতো কাজ করছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা ফেসবুক লাইভে এসে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র হওয়ার পর প্রথম আবিষ্কার করেছি যে, এগুলো দিয়ে লোকজন নানা কিছু করছে। আমার কখনো মাথায়ই আসেনি যে, এগুলো দিয়ে টাকা-পয়সা ইনকাম করা যায়। তাহলে হোয়াই ইন দ্য আর্থ— এটাকে কী আমি একটি মানি মেকিং মেশিনে পরিণত করতে যাব? কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটাই হয়েছে। খুবই কমন, খুবই রেগুলার বেসিসেই হয়েছে।’
গত সোমবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজ যখন পত্রিকায় দেখলাম, বেদনায় একেবারে নীল হয়ে গেছি। দেখলাম পাঁচজন সমন্বয়কারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা জোর করে একটি বাড়ি থেকে একজন সাবেক সংসদ সদস্যের কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে নিয়েছে। এই পরিণতি কী আমরা চেয়েছিলাম! এই বাংলাদেশের মানুষ কি এটা চেয়েছিল? এত তাড়াতাড়ি যদি এসব ঘটনা ঘটে, এক বছরও হয়নি; তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী?
অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে সম্প্রতি বলেন, ‘আজকাল অনেকের লেজ কাটা যাচ্ছে বলে আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। বিভিন্ন দলের কয়েকজন মহারথী এতে জড়িত। সব ষড়যন্ত্রই প্রকাশ পাবে। নিকৃষ্ট শত্রুরাও গত ১২ মাসে আমার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ করলেও দুর্নীতি বা আর্থিক অসংগতির অভিযোগ করেনি। বিভিন্ন দলের মহারথীদের অনেক অসুবিধা হচ্ছে তাতে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব পবিত্র আমানত। হাজার কোটি টাকার চেয়েও ইজ্জত ও রাষ্ট্রের আমানত আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
ওই পোস্টে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ‘নতুন একটি দলের কয়েকজন মহারথী এতে জড়িত। সবই প্রকাশ পাবে। একটা সার্কেলের প্রায় সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত, কিন্তু একজন কোনো টাকা ধরছেন না, এটা কার সহ্য হবে’ লিখেছিলেন—যা পরে এডিট করা হয় উল্লেখ করে গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ও আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ ফেসবুক পোস্টে বলেন, এ কথায়ই স্পষ্ট যে, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম দুর্নীতির অস্তিত্ব জানেন। তিনি জানেন কারা, কোন দল, কোন মহারথী এই ঘৃণ্য খেলায় জড়িত। আমরা জানতে চাই, সেই নতুন দলটি কারা? কোন সার্কেল? কারা ‘গণঅভ্যুত্থান’ নাম নিয়ে শহীদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করছে? তাকে অনুরোধ করব, দুর্নীতি দমন কমিশনকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন। দুর্নীতির তথ্য জেনেও চুপ থাকার মতো অপরাধ করবেন না।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম আরেক সমন্বয়ক এবং স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বাবা বিল্লাল হোসেনের ঠিকাদারি লাইসেন্স নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। সামাজিকমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার মুখে বাতিল করা হয় সেই লাইসেন্স। তবে আসিফ মাহমুদ জানান, তার বাবা নিজে ঠিকাদারি কাজ বা ব্যবসা করার জন্য ওই লাইসেন্স করেননি। স্থানীয় একজন ঠিকাদার নিজের সুবিধার জন্য তাকে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলেন। এ বিষয়ে কিছু জানতেন না জানিয়ে সামাজিকমাধ্যমে পোস্ট করে ক্ষমাও চেয়েছেন তিনি।
এদিকে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি জুলাই মাসব্যাপী ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ পালন করেছে। হাসিনার পতনের এক দফার ঘোষক ও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ অভ্যুত্থানের অন্যতম সাবেক সমন্বয়ক এবং বর্তমান এনসিপি নেতারা এ কর্মসূচিতে সারা দেশ সফর করেন। এতে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিপুল গণজমায়েত হতে দেখা গেছে। এই কর্মসূচিতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চাঁদাবাজিসহ নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এনসিপি নেতারা। রাজনীতিতে সাড়া জাগানো এই নতুন নেতৃত্ব ও তাদের দলকেও তির্যক মন্তব্যের মুখে পড়তে হচ্ছে বৈষম্যবিরোধীদের চাঁদাবাজির ঘটনায়।
দলটির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব আমার দেশকে বলেন, আমরা রাজনৈতিকভাবে এগোনোর সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে আলাদা হয়ে গেছি। গণঅভ্যুত্থান ও পরবর্তীতে ‘বৈষম্যবিরোধীরা সামাজিক কাঠামোতে নানা কারণে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী সংগঠক হয়ে ওঠেন। তবে ‘সমন্বয়কদের চাঁদাবাজি’—এ বিষয়টি যেভাবে ফ্রেমিং করা হচ্ছে, তাতে গণঅভ্যুত্থানের পুরো নেতৃত্বকে ভেরিফাই করার চেষ্টা হচ্ছে। বিতর্ক তৈরির জন্যই এমনটি করা হচ্ছে। খুঁজলে দেখা যাবে, চার-পাঁচটির মতো অভিযোগ পাওয়া যাবে।
২০২৪ সালে নতুন করে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ওই বছরের ১ জুলাই সংগঠনটি সৃষ্টির পর আন্দোলন সফল করতে ৮ জুলাই ৬৫ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে ২৩ জন সমন্বয়ক ও ৪২ জন সহ-সমন্বয়ক ছিলেন। আন্দোলন দানা বাধলে ৩ আগস্ট দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ১৫৮ সদস্যের কমিটি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৪৯ জনকে সমন্বয়ক ও ১০৯ জনকে সহ-সমন্বয়ক করা হয়। সংগঠনটির ব্যানারে ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় টানা ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্রনেতৃত্বের একটি অংশ জাতীয় নাগরিক পার্টি গঠন করে, যা পরে এনসিপি নামে রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হয়। অপর একটি অংশ বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) গঠন করে, যা এনসিপির ছাত্রসংগঠন হিসেবে কাজ করছে। বৈছাআতে ইসলামি ছাত্রশিবির থেকে আসা অংশ নিজ সংগঠনের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হয়েছে। একইভাবে ছাত্রদলসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরাও তাদের সংগঠনে ফিরে গেছে। সাবেক শিবির নেতাকর্মীরা গড়ে তুলেছেন ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ বা আপ বাংলাদেশ। এ ছাড়া ইনকিলাব মঞ্চসহ অন্যান্য সংগঠন তাদের মতো করে সক্রিয় রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলো বিভাজনের কারণে ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে জুলাই স্পিরিট বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। বিদ্যমান কাঠামোতে চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অনিয়ম মহামারি আকার ধারণ করায় নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েমের গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। নতুন বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের পাশাপাশি গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের এমন অনিয়মে জড়িয়ে পড়ায় হতাশা বাড়াবে মানুষের।