Image description

দেশের গ্যাস সরবরাহ সংকট কমাতে বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করছে সরকার। অথচ দেশে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় প্রতি বছরই সিস্টেম লস হচ্ছে বিপুল পরিমাণ গ্যাস। যার আর্থিক  মূল্য ৪ হাজার কোটি টাকার মতো। উচ্চচাপ ক্ষমতাসম্পন্ন সঞ্চালন কোম্পানির গ্যাস অপচয়ের কোনো সুযোগ দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন মনে করেন সঞ্চালন কোম্পানির ২ শতাংশ সিস্টেম লস কোনোভাবেই হতে পারে না। এটা নতুন করে উদ্বেগের বিষয়। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত গ্যাস খাতে সিস্টেম লস (সঞ্চালন ও বিতরণ পর্যায়ে) ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর সেই গ্যাসের পরিমাণ ১ হাজার ৪৫১ মিলিয়ন ঘনমিটার। গ্যাসের ভারিত গড়ের হিসাব ধরলে এর আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। তবে অর্থবছরের পুরো হিসাব ধরলে এই ক্ষতি ৪ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

আর এ অর্থ সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ভর্তুকির প্রায় অর্ধেক। ২০২৪-২৫ অর্থবছরেও প্রায় একই পরিমাণ গ্যাস সিস্টেম লস হিসেবে দেখিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পেট্রোবাংলা। বিতরণ ব্যবস্থায় ত্রুটি, অবৈধ সংযোগ ও চুরি যাওয়া গ্যাসকে ‘সিস্টেম লস’ হিসেবে উল্লেখ করে পেট্রোবাংলা। জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, উচ্চমূল্যের গ্যাস কিনে বিতরণ কোম্পানিগুলো সিস্টেম লস বা গ্যাসকে চুরি হিসেবে দেখানো রীতিমতো উদ্বেগের। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, স্বচ্ছ জবাবদিহি ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগের মাধ্যমে এ লোকসান কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন তারা। বলেন, সিস্টেম লসের নামে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ গ্যাসের কোনো হিসাবই পাওয়া যাচ্ছে না।
২৯শে জুলাই পেট্রোসেন্টারে ‘দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা, প্রতিবন্ধকতা, মোকাবিলা ও মিডিয়ার ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বাংলাদেশ প্রকৌশল (বুয়েট)-এর সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন এসব তথ্য তুলে ধরেন। উত্থাপিত প্রতিবেদনেই সিস্টেম লসের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উঠে আসে।

পেট্রোবাংলার উত্থাপিত আর্থিক প্রতিবেদনের হিসাব থেকে জানা যায়, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত গ্যাস খাতে সিস্টেম লস (সঞ্চালন ও বিতরণ পর্যায়ে) ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আর সেই গ্যাসের পরিমাণ ১ হাজার ৪৫১ মিলিয়ন ঘনমিটার। গ্যাসের ভারিত গড়ের হিসাব ধরলে এর আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। তবে অর্থবছরের পুরো হিসাব ধরলে এ ক্ষতি ৪ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আগের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) পেট্রোবাংলার বিতরণ কোম্পানিগুলোর সিস্টেম লসে গ্যাস অপচয় ও চুরি যায় ২ হাজার ৩৬ মিলিয়ন ঘনমিটার, আর্থিক হিসাবে যা ৩ হাজার ৭৮৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। দেশের গ্যাস সরবরাহ সংকট কমাতে বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করছে সরকার। স্থানীয় গ্যাসের সঙ্গে মিশিয়ে তা গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রিতে যে অর্থের ঘাটতি থাকছে সেটি ভর্তুকির টাকায় পূরণ করছে পেট্রোবাংলা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সংস্থাটি গ্যাস খাতে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পেয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। সে অর্থের প্রায় অর্ধেক পরিমাণ ক্ষতি হয় চুরি-অপচয় হওয়া গ্যাসে। দেশের উৎপাদন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে গ্যাস নিয়ে বিতরণ কোম্পানির ইনটেক পয়েন্টে তা পৌঁছে দেয়ার কাজটি করছে সঞ্চালন সংস্থা গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। উচ্চচাপ ক্ষমতাসম্পন্ন এ সঞ্চালন কোম্পানির গ্যাস অপচয়ের সুযোগ দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তবু সঞ্চালন কোম্পানির সিস্টেম লস ২ শতাংশ। 

মিটারিংয়ের মাধ্যমে ধরা পড়া এ সিস্টেম লসকে চুরি কিংবা নষ্ট হিসেবেও দেখছে না পেট্রোবাংলা। এটি কারিগরি ত্রুটি হিসেবে বিবেচনা করছেন সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। গ্যাস বিতরণ কোম্পানির পাশাপাশি সঞ্চালন কোম্পানির এ সিস্টেম লসে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, উচ্চচাপ ক্ষমতাসম্পন্ন গ্যাসের লাইন দিয়ে কীভাবে গ্যাস অপচয় বা কারিগরি ত্রুটি হচ্ছে সেটা খতিয়ে দেখার বিষয়। বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, সঞ্চালন কোম্পানির ২ শতাংশ সিস্টেম লস কোনোভাবেই হতে পারে না। এটা নতুন করে উদ্বেগের বিষয় বলে তিনি মনে করেন। বিষয়টি পেট্রোবাংলাকে আরও গভীরভাবে খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন তিনি।

বিপুল পরিমাণ গ্যাসের সিস্টেম লস নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান বলেন, গ্যাসের সিস্টেম লস পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা হচ্ছে। আশার কথা হলো সেটি এখন সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হয়েছে। তবে সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ত্রুটির বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ বন্ধেও তৎপর আছে পেট্রোবাংলা। বর্তমানে ছয়জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ বিষয়ে সার্বক্ষণিক দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করছেন। গ্যাস খাতের অপচয়, চুরি রোধ করতে পেট্রোবাংলা অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন, পাইপলাইন উচ্ছেদ, অভিযান ও টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে বলেও জানান তিনি।