
জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূতি সামনে রেখে দেশে বড় ধরনের অস্থিরতার নীল নকশা করেছে পতিত আওয়ামীলীগ। ভারতে বসে এ নীল নকশার ছক একেছেন ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা। এজন্য দেশে বিদেশে থাকা দোসরদের বিভিন্ন দায়িত্বও দেয়া হয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকা-ে পারদর্শী ও ‘ডাই হার্ট’ আওয়ামী লীগারদের বাছাই করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বিশেষ কারাগারে বিলাসী জীবনে থেকেও আ’লীগের সাবেক মন্ত্রীরা দেশ বিরোধীসহ অন্তবর্তীকালিন সরকারকে হঠাতে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা করছে। এসব বন্দিরা নিজেদের অনুগতদের দিয়ে দেশে নাশকতার চেষ্টা করছে।
পতিত আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের ছকের অংশ হিসেবে মাইলস্টোনে স্কুলে উপদেষ্টাদের আটকে রাখা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পর সচিবালয়ে আগুন ও জিরো পয়েন্টে অরাজকতা চালানো হয়। একটি গোয়েন্দা তদন্তের সূত্রে এমনটাই উঠে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, সচিবালয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পাশাপাশি শাহবাগ দখল করার পরিকল্পনা ছিল আওয়ামী লীগের। এর নির্দেশদাতা ছিলেন আ’লীগের প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খান। সচিবালয় ও গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে তা-বে জড়িতদের মধ্যে গ্রেফতারকৃত খোরশেদ আলম গোপালগঞ্জ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। গ্রেফতার অন্যরাও ছাত্রলীগ সদস্য এবং আওয়ামী পরিবারের সদস্য। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছাত্রলীগ যে সব ঝটিকা মিছিল করেছে ওই সব মিছিলে থাকা সকলকে অর্থের যোগান দিয়েছেন কারাগারে বসেই এসব ভিআইপি বন্দিরা।
এদিকে কারা অধিদপ্তরের সূত্রমতে, কেরানিগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে গত ২১ জুন থেকে চালু হয়েছে একটি বিশেষ কারাগার। যা বিশেষভাবে ভিআইপি বন্দিদের জন্য নির্মিত। এ কারাগারে ২৫০ জন ভিআইপি বন্দি রাখার ক্ষমতা রয়েছে। ইতিমধ্যে এখানে ১৬৮ জন বন্দি স্থানান্তর করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ৫৮ জন ভিআইপি বন্দি। বাকিরা তাদের রান্না-বান্নাসহ অন্যান্য কাজের জন্য কর্মচারি। এসব ভিআইপি বন্দির সবাই আওয়ামীলীগের সাবেক এমপি-মন্ত্রী ফ্যাসিস্ট সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ভিআইপি বন্দিদেরও এখানে আনা আনা হবে। ইতিমধ্যে যে সব এই বিশেষ কারাগারে স্থানান্তর করা ভিআইপি সকল বন্দির নাম কারা কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করতে অনিহা প্রকাশ করলেও এদের বেশিরভাগই কাশিমপুর হাই সিকিউরিটিজ সেলে বন্দি ছিলেন।
জানা গেছে, এ বিশেষ কারাগারে আওয়ামীলীগের ভিআইপি বন্দিদের জন্য রয়েছে বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা। এখানে একই সেলে এক সঙ্গে থাকতে পারেন একাধিক বন্দি। পাশাপাশি সেলে থাকা বন্দিরাও পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পান। সাধারণ বন্দিদের বিকেলে লকলআপে ঢুকানো হলেও ভিআইপি বন্দিরা অনুমতি সাপেক্ষে হাঁটতে পারেন। তাদের জন্য দরজা রাত ৯টার দিকে বন্ধ করা হয়। ভিআইপিদের কক্ষের আয়তন ১০ থেকে ১২ ফিট। প্রতিটি কক্ষে এ্যাটাচ ওয়াশরুম। রয়েছে খাঁট, টেবিল, চেয়ার, টেলিভিশন ও দুইটি পত্রিকা পড়ার সুযোগ। তাদের জন্য রয়েছে রান্নার আলাদা ব্যবস্থা। অধিকাংশ বন্দিই নিজেদের ইচ্ছেমতো রান্না করা খাবারই খান। তবে জেলের নিয়মানুসারে ভিআইপিদের জন্য সকালের নাস্তায় রয়েছে রুটি, ডাল, সবজি এবং জেলি। দুপুরে ও রাতে মাছ, গোস্তও ডাল। সেখানে সাধারণ বন্দিরা মাত্র ১ বেলা মাছ ও গোস্ত পান। এ ভিআইপি বন্দিদের জন্য বিশেষ কারাগার মূলত দেশের প্রভাবশালী বন্দিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের ব্যবস্থা করেছে। তাদের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবন যাপনের অবকাঠামো। এটি দেশের কারা ব্যবস্থাপনায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে নি:সন্দেহে। কিন্তু বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, বর্তমানে ওই বিশেষ কারাগারে অবস্থানরত ভিআইপি বন্দিদের নির্দেশেই জুলাই আন্দোলনে ছাত্র জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও ফ্যাসিস্ট সরকারের পেটোয়া বাহিনী ছাত্রলীগ-যুবলীগ। কাজেই এসব বন্দিরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার সুযোগ পেলে তারা নতুন কোনো ষঢ়যন্ত্র করে দেশকে অস্থীতিশীল করে তোলার পায়তারা করবে। তাছাড়া সাধারণ বন্দিদের তুলনায় এসব ভিআইপি বন্দিদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার কতটা প্রয়োজনীয়তা এবং কতোটা ন্যয্যতা রয়েছে এমন প্রশ্নও থেকে যায়। তাদের নিয়ে এসব প্রশ্ন দেখা দিতো না, যদি তারা ফ্যাসিস্ট সরকারের এমপি-মন্ত্রী না হতেন। একজন কারারক্ষি জানান, দীর্ঘদিন ধরে থাকায় এখন এসব বন্দিরা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এখন আর কোনো আবদার করেন না। তবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে না দেয়ার আক্ষেপ রয়েছে তাদের। নিরপত্তার স্বার্থে কারা কর্তৃপক্ষ তা মঞ্জুর করছেনা।
বিশেষ এই কারাগারের একই সেলে একসাথে থাকা, সেলের বাইরে হাঁটাহাটি করার সুযোগ থাকা, বই পড়ার নামে এরা পাঠাগার গিয়েও নিজেদের মধ্যে কি ধরনের আলোচনা করছে সেটি গুরুত্বের সাথে নজরদারির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
যদিও এসব বন্দিরা হত্যা, আইসিটি এ্যাক্টসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। হাজিররার জন্য একই গাড়িতে কোর্টে আনা-নেয়ার সময়, আদালতের হাজতে এবং কোর্টে তোলার সময় নিজেদের মধ্যে আলোচনা, পরামর্শ করার লম্বা সময় পান। কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকার আদালতে গাড়িতে আনা নেয়ায় অন্তত তিন ঘন্টা সময় পান বন্দিরা। এ সময় তাদের মধ্যে রাজনৈতিক আলোচনা হয়। কোর্টে তোলার আগে পরে, কোর্ট হাজতে স্বল্পকালীন অবস্থানকালে বাইরের অনুসারীদের তারা বিভিন্ন নির্দেশ ও পরিকল্পনার তথ্য ফাঁস করেন। বাইরে থাকা দোসররা তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালায়। কারা সূত্র জানায়, বর্তমানে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটিজ সেলেও ১৫ জন ভিআইপি বন্দি রয়েছেন। এভাবে সারা দেশে বন্দিদের আদালতে আনা নেয়ার সময় পরিকল্পনার সুযোগ পান। তবে ঢাকার কেরানিগঞ্জে গত মাসে চালু হওয়া ভিআইপিদের জন্য বিশেষ কারাগারে যেহেতু হাই প্রোফাইল বন্দি রয়েছেন কাজেই তাদের দিকে বিশেষ নজর দেয়ার গুরুত্ব রয়েছে। এখানে পর্যায়ক্রমে আরও ভিআইপি বন্দি আনা হচ্ছে।
বিশেষ এই কারাগারে কতজন ভিআইপি বন্দি রয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ তা প্রকাশ করলেও নিরাপত্তাজনিত কারনেই সকলের নাম প্রকাশ করেননি। তবে একটি সূত্র জানায়, বিশেষ এ কারাগারে অবস্থানরত ভিআইপি বন্দিদের মধ্যে রয়েছেন, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শাজাহান খান, সাধন চন্দ্র মজুমদার, হাসানুল হক ইনু, কামরুল ইসলাম, সালমান এফ রহমান, এ বি এম তাজুল ইসলাম, ফরহাদ হোসেনসহ আরও অনেকে। রয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটির সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী ও এমপির মতো ভিআইপি বন্দি।
বিশেষ এ কারাগারে ভিআইপি বন্দিদের একসাথে রাখায় তারা সরকার বিরোধী কোন পরিকল্পনার সুযোগ পাচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে সহকারী কারা মহাপরিদর্শক জান্নাতুল ফরহাদ ইনকিলাবকে বলেন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বন্দিকে পৃথক পৃথক সেলে রাখা হয়েছে। তারা কারাগারে থাকা অন্য ভিআইপিদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন না। এছাড়া যে সকল কক্ষে একাধিক বন্দি রাখা হয়েছে তাদের সার্বক্ষনিক নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। সকল কারারক্ষীকে বডিক্যামের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই ক্যামেরার মাধ্যমে কারারক্ষী ও বন্দিদের সব কর্মকান্ড ও কথোপকথন অডিও-ভিডিও রেকর্ড করা হয়। কারাগারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এসব মনিটর করেন। নিরাপত্তার স্বার্থে কারাগারে রয়েছে আধুনিক সিসি ক্যামেরা, বডিক্যাম এবং এআই প্রযুক্তির নজরদারি ব্যবস্থা। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। বিশেষ কারাগারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সুনাম ও দক্ষতায় নির্বাচিত। পুরো কারাগারটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ঘিরে রাখা হয়েছে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোর। মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক জ্যামার ব্যবহার করা হয়, যাতে বন্দিরা কোনো অবৈধ যোগাযোগ করতে না পারে। কেউ যদি মনে মনে কোন পরিকল্পনা করতে পারে। তাতে কি আসে যায়।
মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর তৈরি হচ্ছিল একটি বিশেষ কারাগার। সেখানে প্রথম বন্দি হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। সে অনুযায়ী প্রস্তুতিও নিচ্ছিল কারা কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে ২০২০ সালে কভিড সংক্রমণের কারণে সরকারের নির্বাহী আদেশে ছয় মাসের জন্য খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া হয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। পরে একের পর এক মামলা থেকে খালাস পান খালেদা জিয়া। তাই তাকে আর জেলে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি।