চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানি বৃদ্ধি, ভর্তুকি মূল্যে বিক্রিসহ সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও কাজে আসছে না কিছুই। এক মাস ধরে দাম বেড়েই চলেছে দেশের প্রধান খাদ্যশস্যের। এই সময়ে কেজিতে সর্বোচ্চ ১০ টাকা পর্যন্ত দর বেড়েছে চালের। এ ছাড়া আগের মতোই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে মুরগি। সবজির বাজারের কিছুটা স্বস্তি মিইয়ে যাচ্ছে মুরগি কিনতে গেলেই। আমনের ভরা মৌসুমে চালের চড়া দর নিয়ে খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতা এবং মিলাররা দুষছেন একে অপরকে। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি, ভরা মৌসুমেও ধানের সংকট দেখিয়ে দর বাড়াচ্ছেন মিলাররা। মিল পর্যায়ে সরকারের নজরদারি না থাকার সুযোগটাই নেওয়া হচ্ছে। তবে মিলারদের দাবি, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষক ধানের দাম বাড়িয়েছে। পাশাপাশি একশ্রেণির ব্যবসায়ী কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে মজুত করে এখন ইচ্ছামতো দর বাড়াচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মগবাজার ও তেজকুনিপাড়া বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সব ধরনের চালের দর বেড়েছে। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল ৭৬ থেকে ৮০ টাকায় এবং নাজিরশাইল ৮০ থেকে ৮৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাসখানেক আগেও মিনিকেট ৬৮ থেকে ৭৫ এবং নাজিরশাইল ৭০ থেকে ৭৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেই হিসাবে দু্ই জাতের চালের কেজিতে বেড়েছে যথাক্রমে ৫ থেকে ৮ এবং ৮ থেকে ১০ টাকা। এক মাস আগে মাঝারি মানের, অর্থাৎ বিআর-২৮ জাতের চালের কেজি ছিল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। ২ থেকে ৫ টাকা বেড়ে সেই চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। এ ছাড়া এই সময়ে মোটা চালের (গুটিস্বর্ণা) কেজিতে বেড়েছে ১ থেকে ৪ টাকা। এক মাস আগে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজির মোটা চালে এখন গুনতে হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা। আমদানি করা ভারতীয় চালও বেচাকেনা হতে দেখা গেছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা মিনিকেট নামে এ চালের কেজি বিক্রি করছেন ৭৬ থেকে ৭৮ টাকায়।
সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্যমতে, গত এক মাসে সরু চালের দর ৪ শতাংশ, মাঝারি চালে আড়াই এবং মোটা চালের দর ৭ শতাংশ বেড়েছে। তবে এক বছরের ব্যবধানে গড়ে সব ধরনের চালের কেজিতে বেড়েছে ১৬ শতাংশ।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি আমন মৌসুমে ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বন্যায় কিছু এলাকার জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেখানে ফের আবাদ করা যায়নি। এতে আবাদ হওয়া ৫৬ লাখ হেক্টর জমির মধ্যে ৫৩ লাখ হেক্টরের ধান কাটা হয়েছে।
উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৬৫ লাখ টন ধান, যদিও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৭৮ লাখ টন। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমন মৌসুমে রেকর্ড ১ কোটি ৬৬ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছিল। তবে সেই তুলনায় এবার উৎপাদন কম হয়নি। তা ছাড়া এখনও ৩ লাখ হেক্টর জমির ধান কাটা বাকি রয়েছে।এদিকে ক্রমাগত দাম বাড়ায় ভারত থেকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কয়েক দফায় চাল আমদানি হয়েছে। এতে দাম কমার কথা থাকলেও উল্টো বাড়ছে। এ নিয়ে কারওয়ান বাজারের চালের দোকান নিউ বরিশাল ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী ফজলুল হক সমকালকে বলেন, মিলার বলছেন কৃষকের কাছ থেকে ধান পাচ্ছেন না। এখন সরকারের মিলে গিয়ে দেখা দরকার আসলে ধান আছে কিনা। তিনি অভিযোগ করেন, এ সরকার উৎপাদন এলাকার মিলগুলোতে তদারকি করছে না। এই সুযোগে মিলাররা দাম বাড়াচ্ছেন।
তবে মিলারদের ভাষ্য, গত বছরের তুলনায় এবার ৭৫ কেজির প্রতি বস্তা ধানের দাম বেড়েছে প্রায় ৩০০ টাকা। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি শহিদুর রহমান পাটোয়ারী সমকালকে বলেন, গত বছর যে ধানের বস্তা কেনা গেছে ২ হাজার ২০০ টাকা। এবার তা কিনতে খরচ হচ্ছে ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫৫০ টাকায়। কৃষক বাজারে দর বেশি পাওয়ায় সরকারকে ধান দিচ্ছে না। এ ছাড়া মজুতদারদের সংখ্যা বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। তারা কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে এখন নিজেদের মতো দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। আর মিলাররা ভুগছে ধানের সংকটে। মজুতদারদের কাছে কী পরিমাণ ধান রয়েছে, তা তদন্ত করলেই বাজার নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
৩০ টাকা কেজিতে মিলবে ওএমএসের চাল
বাজার নিয়ন্ত্রণে ভর্তুকি মূল্যে চাল বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গতকাল খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ওএমএসের আওতায় সারাদেশে ১ হাজার ৭৫২টি বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে দৈনিক ১ হাজার ৭৫২ টন চাল বিক্রি করা হবে। প্রতি কেজি ৩০ টাকা দরে প্রত্যেক ক্রেতা পাঁচ কেজি করে চাল কিনতে পারবেন। প্রথম পর্যায়ে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
আলাদিনের চেরাগ নেই যে, সুইচ দিলে বাজার ঠিক হবে
চালের দাম নিয়ন্ত্রণে নিজের কাছে কোনো মেশিন নেই বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের কষ্ট হচ্ছে, এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবে এ সমস্যা সাময়িক। আসলে এমন কোনো আলাদিনের চেরাগ তো নেই যে, সুইচ দিলেন আর কালকেই বাজার ঠিক হয়ে যাবে। তবে বাজার স্বাভাবিক রাখতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে।তিনি বলেন, তথ্য-উপাত্ত বলছে, চালের মজুতে কোনো ঘাটতি নেই। আমদানিতে শুল্ক ৬৩ থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় কয়েক লাখ টন চাল সরাসরি আমদানি করছে। মিয়ানমার, পাকিস্তান ও ভারত থেকে চাল আমদানির পাশাপাশি এখন আমনের ভরা মৌসুম চলছে। এপ্রিল নাগাদ বোরো ধান আসবে। আশা করা যায়, এর মধ্যেই বাজার ঠিক হয়ে যাবে।
এদিকে চালের দাম বাড়লেও সবজির দর তলানিতে। বেশির ভাগ সবজি কেনা যাচ্ছে ৫০ টাকার কমে। প্রতি কেজি মুলা ও শালগম ১৫ থেকে ২০, শিম ২৫ থেকে ৫০, গাজর ৫০ থেকে ৫৫, চিচিঙা ৩৫ থেকে ৪০, উচ্ছে ৩০ থেকে ৫০, বেগুন ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি টমেটো মানভেদে ৫০ থেকে ৬০ এবং বরবটি ৫০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া বড় আকারের প্রতিটি ফুল ও বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়। লাউয়ের পিস কেনা যাচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। কাঁচামরিচের কেজি কেনা যাবে ৪০ থেকে ৬০ টাকায়।তবে আগের মতোই চড়া মুরগির বাজার। প্রতি কেজি ব্রয়লার ১৯০ থেকে ২০০ এবং সোনালি জাতের মুরগি ৩৩০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ান বাজারের নূরজাহান ব্রয়লার হাউসের বিক্রয়কর্মী মাঈন উদ্দীন বলেন, শীতের সময় বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান থাকায় মুরগির মাংসের চাহিদা বাড়ে। এ কারণে দাম চড়া।
অবশ্য ডিমের দর কমেছে। প্রতি ডজন ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায়।আরও কমেছে আলুর দর। বড় বাজারগুলোতে প্রতি কেজি কেনা যাচ্ছে ৩০ টাকা দরে। দুই কেজি একসঙ্গে কিনলে মিলছে ৫০ টাকায়। তবে এলাকাভিত্তিক ছোট বাজারে এখনও আলুর কেজি ৪০ টাকা রাখছেন ব্যবসায়ীরা। পেঁয়াজের দরও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। প্রতি কেজি দেশি নতুন পেঁয়াজ ৫০ থেকে ৫৫ ও পুরোনো পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে কেনা যাচ্ছে। এ ছাড়া গরুর মাংসের কেজি কেনা যাচ্ছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকায়। তবে গত সপ্তাহের তুলনায় মাছের দর কিছুটা বাড়তি দেখা গেছে।