Image description
 

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) ঐতিহাসিক জলবায়ুবিষয়ক রায়কে ঘিরে বাংলাদেশে আশার চেয়ে সংশয়ই বেশি। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ আন্দোলনের নেতারা মনে করছেন, এই রায়ের বাস্তব প্রভাব বাংলাদেশের জন্য খুব একটা সুফল বয়ে আনবে না, বরং বড় দেশগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অপেক্ষাকৃত বেশি কার্বন নির্গমন করা পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই হিতে বিপরীত হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি রফতানি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর শর্তে এই শুল্ক পুনর্বিবেচনার কথা বলা হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র এমন এক গোপন চুক্তির কথা বলছে যা সই করলেও সরকারের তরফ থেকে সাধারণ মানুষকে কিছু জানানো সম্ভব হয়নি। এই গোপনীয়তা ও শুল্ক নীতিকে কেন্দ্র করে দেশের জনগণের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ধনী দেশগুলোর এমন নিষ্পেষণমূলক আচরণের ক্ষেত্রে মামলা-মোকদ্দমা করে আন্তর্জাতিক আদালতে খুব একটা সুবিধা পাওয়া যাবে না। বড় লড়াইয়ে নামলে তারা অপেক্ষাকৃত ছোট ও অনুন্নত দেশগুলোর ওপর নানা ধরনের বাণিজ্যিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে পারে, যা ছোট দেশগুলোর পক্ষে বহন করা কঠিন। এর বদলে বিশ্বের সব দেশকে মিলিত হয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যুক্তিযুক্ত।

আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা ও পরিচালনা করা সময়সাপেক্ষ ও অর্থসাপেক্ষ একটি প্রক্রিয়া। বড় দেশগুলো এই প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত হলেও ছোট দেশগুলো এ ক্ষেত্রে খুব সুবিধা করতে পারে না।

এই ঐতিহাসিক রায়ে আসলে বাংলাদেশের কোনও সুবিধা হবে কিনা বা অসুবিধা হবে কিনা জানতে চাইলে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, এর ফলে বাংলাদেশের কোনও পরিবর্তন হবে না। এতে বাংলাদেশের কোনও সুফলও আসবে না। কারণ মামলার যে সিদ্ধান্ত তা বাস্তবায়ন করার পেছনে কোনও শক্তি নেই। ফলে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে কে? কেউ মামলা করলে অন্য দেশ যদি বলে আমরা এই সিদ্ধান্ত মানি না। তাহলে আর সেটি কার্যকর থাকে না। এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এটি কোন শক্তি দিয়ে বাস্তবায়ন করা হবে তা আলোচনায় নেই। তিন বলেন, দীর্ঘ দিন ধরেই এই বিষয়ে আলোচনা চলছে কিন্তু এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত এলেও উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই।

জানতে চাইলে ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়কারী শরীফ জামিল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কোনও সরকার যদি মামলা করতো তাহলে তো সে ফসিল-ফুয়েল দিয়ে জ্বালানি উৎপাদনের কাজই করতো না। কোনও দেশের সরকার নিজেই যদি ফসিল-ফুয়েল দিয়ে জ্বালানি উৎপাদনের কাজ করে তাহলে তার পক্ষে মামলা করা সম্ভাবনা কম। তিনি বলেন, এটি একটি নৈতিক বিষয়। ভবিষ্যতে যারা ফসিল-ফুয়েলে বিনিয়োগ করতে চাইবে তাদের জন্য এটি একটি নিরুৎসাহিত করার মতো বিষয় হতে পারে। এটি একটি ভালো দিক। তিনি বলেন, এই মামলা করার সিদ্ধান্তের কারণে ফসিল-ফুয়েল নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদেরকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু সরকারের পলিসির ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। সরকার যদি নিজেই ফসিল-ফুয়েল নিয়ে কাজ করতে শুরু করে তাহলে তার পক্ষে তো মামলা করা সম্ভব নয়।

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)-এর প্রধান নির্বাহী সিদ্দিকা সুলতানা বলেন, আসলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে বাংলাদেশের মতো ছোট দেশগুলো তেমন কোনও সুবিধা পাবে না। এশিয়ার দেশগুলো যেমন—বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের মতো ছোট দেশগুলো বড় দেশগুলোর বিরুদ্ধে মামলা এমনিতেই করতে পারবে না অর্থনৈতিক কারণেই। তারপরও বড় রাষ্ট্রগুলো ফসিল-ফুয়েল নিয়েই বেশ কাজ করছে। এক্ষেত্রে এই মামলা করার সিদ্ধান্ত খুব বেশি কাজে লাগবে না। তবে মামলা তারা করতেই পারে, তবে সুফল পাবে না।  তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা করলেও নতুন কোনও উদ্যোগ বা পরিবর্তন হচ্ছিল না সে ক্ষেত্রে যে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি।

প্রসঙ্গত, গত ২৩ জুলাই নেদারল্যান্ডসের হেগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত পরামর্শমূলক রায়ে জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দেশগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো আন্তর্জাতিক আইনে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারবে। এই রায় বাধ্যতামূলক না হলেও জলবায়ু-ন্যায়ের ক্ষেত্রে এটি যুগান্তকারী নির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

এই মামলার সূচনা হয়েছিল ভানুয়াতুসহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তরুণদের উদ্যোগে। তারা দাবি তুলেছিল, দূষণকারী বড় দেশগুলো ইতিহাসের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না।

ভানুয়াতুর নেতৃত্বে ১৬টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ জাতিসংঘে এই আদেশের জন্য আবেদন করে এবং ১৩২টি দেশ, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে, এর পক্ষে ভোট দেয়। তবে বাস্তবায়নের কাঠামো না থাকায় এই রায়ের প্রভাব বাংলাদেশসহ ছোট দেশগুলোর জন্য সীমিতই থাকবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।