বাংলাদেশ নিয়ে ২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর এক বিবৃতি দেয় রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা মস্কো থেকে প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আরব বসন্তের মতো পরিস্থিতি ঘটাতে পারে।’
জাখারোভা তার বিবৃতিতে শেখ হাসিনা সরকারকে পশ্চিমাদের কাছে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘১২ ও ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি জেলায় সরকারবিরোধীরা সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়, বাসে আগুন দেয় এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আমরা এ ঘটনাগুলোর সঙ্গে ঢাকায় অবস্থিত পশ্চিমা কূটনৈতিক মিশনগুলোর উসকানিমূলক কার্যকলাপের সরাসরি যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছি। বিশেষ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের।’
হাসিনা সরকারকে চাপে ফেলতে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞার মতো হাতিয়ারের শরণাপন্ন হতে পারে উল্লেখ করে বিবৃতিতে মারিয়া জাখারোভা বলেন, ‘আগামী সপ্তাহগুলোয় বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাসহ চাপের আরো বিস্তৃত অস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলো আক্রমণের শিকার হতে পারে। পাশাপাশি বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রমাণ ছাড়াই ৭ জানুয়ারির আসন্ন সংসদ নির্বাচনে নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত গণতান্ত্রিক প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করার অভিযোগ আনা হতে পারে। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জনগণের ভোটের ফলাফলে সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে আরব বসন্তের মতো বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরো অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টার সম্ভাবনা রয়েছে।’
ওই সময় বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক বিবৃতি রেখেছে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদের এসব বিবৃতিতে বাংলাদেশে মার্কিন তৎপরতাকে বিশেষ করে রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কর্মকাণ্ডকে অন্য একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্থূল হস্তক্ষেপ বলে আখ্যা দেয়া হয়।
তবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়ার ওই বার্তাকে গুরুত্ব দেননি। এমনকি নিজ স্বার্থে বাংলাদেশকে সবসময় পর্যবেক্ষণে রাখা প্রতিবেশী ভারতও ওই বার্তাকে সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করেনি বলে মনে করেছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।
মারিয়া জাখারোভার ওই বিবৃতির দুদিন পর ২০২৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘রাশিয়া কী বলেছে, এটা আমাদের ইস্যু না। এ বিষয়ে ওদেরকেই জিজ্ঞেস করেন। অনেকে অনেক ধরনের কথা বলবে। কিন্তু আমরা এ নিয়ে কিছু বলতে চাই না।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বার্তায়ই হাসিনা সরকার যে রাশিয়ার কথায় গুরুত্ব দেয়নি তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল বলে মনে করছেন সোভিয়েত অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (এসএএবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. শামসুদ্দিন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাশিয়ার ওই বার্তার পর এ নিয়ে কোনো কথাই বলতে চাননি। তা থেকেই রুশ মুখপাত্রের কথার গুরুত্ব যে দেয়া হয়নি, সেটা বোঝা গিয়েছিল।’
এর কয়েক মাস পর গত ৫ আগস্ট এক গণ-অভ্যুত্থানে পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কারের দাবিকে নিষ্ঠুর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমনের নীতি আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য পতন ডেকে আনে। বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে হয় শেখ হাসিনাকে। একই সঙ্গে গণহত্যার দায়ে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও ভূরাজনীতির কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মতে, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী শেখ হাসিনার ধারণা ছিল রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে যেকোনো পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবেন তিনি। এ কারণে রাশিয়ার বার্তাকে গুরুত্ব দেননি তিনি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের আগে শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবকেও এমন সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যেও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কাজ করছিল যে বাংলাদেশে কেউ তার দিকে বন্দুক তাক করার সাহস করবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদের মতে, সে সময় রাশিয়ার কথায় গুরুত্ব দেয়নি বলেই তৎকালীন সরকার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনায় বসেনি বা সেগুলো বিবেচনায় নেয়নি।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির গোটা বিষয়টিকে দেখছেন অভ্যন্তরীণ কারণপ্রসূত হিসেবে। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের যে পরিবর্তন হয়েছে এটি মূলত অভ্যন্তরীণ উপাদান থেকেই তৈরি। এখানে বাইরের প্রেফারেন্স, মতামত বা অবস্থান খুব সহায়ক হয়নি। ভারতও কিছু করতে পারেনি। তার স্বার্থ তো আরো বড় ছিল। তারা কিছু করতে পারেনি, কারণ ঘটনাগুলো দ্রুতই ঘটেছে। ফলে তারা বুঝতে পারেনি। আন্দোলনটা একেবারেই অভ্যন্তরীণ অবস্থাপ্রসূত। ছাত্রদেরও দেখা যায়নি কোনো বিদেশী বিষয়কে এর মধ্যে নিয়ে এসেছে। একেবারেই অভ্যন্তরীণ ওই অবস্থাকে তৎকালীন সরকার মিসহ্যান্ডেল করেছে এবং তাতে করে যা হওয়ার তাই হয়েছে। বাইরের কারো এর মধ্যে থাকার সুযোগ ছিল বলে আমি মনে করি না।’
তিনি বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে সরকার সে সময় কোনো সমস্যাই মনে করেনি। আমার ধারণা যুক্তরাষ্ট্র কী বলল না বলল সেটা শুনতে তখনকার সরকার আগ্রহী ছিল না। আর রাশিয়া কী বলে, সে বিষয়েও বিগত সরকার আগ্রহী ছিল বা গুরুত্ব দিত বলে আমার মনে হয় না। এতগুলো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু তারা তো এ প্রাণহানি নিয়েও চিন্তিত ছিল না। গায়ের জোরে যত শক্তি প্রয়োগ করা দরকার, সেটা করতে তারা প্রস্তুত ছিল।’
সাম্প্রতিক সময়ে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক নতুন করে আন্তর্জাতিক মহলের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প থেকে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা কমিশন হিসেবে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি তদন্ত শুরু করেছে। যুক্তরাজ্যে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়েছে শেখ হাসিনার বোনের মেয়ে এবং ব্রিটিশ লেবার পার্টি সরকারের ইকোনমিক সেক্রেটারি টু দ্য সেক্রেটারি ও সিটি মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিককে।
প্রকল্পটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ব্যয়ে নির্মিত বিদ্যুৎ প্রকল্প। প্রকল্পটির বিপুল অংকের ঋণ নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্যমতে, বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্মিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের বোঝাকে আরো ভারী করে তুলেছে।
ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প ছাড়াও রাশিয়ার সঙ্গে বিগত শাসকগোষ্ঠীর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে নিষেধাজ্ঞাসহ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্কের বৈরিতা দিনে দিনে বেড়েছে। শুধু বাংলাদেশ না রাশিয়ার সঙ্গে যেসব দেশের মিত্রতা ছিল সবাইকেই যুক্তরাষ্ট্রভীতির মধ্যে নিয়ে যাওয়ার একটা প্রচেষ্টা মস্কোর পক্ষ থেকে ছিল। এ প্রেক্ষাপটে আমার মনে হয় না রাশিয়া যথাযথ গোয়েন্দা তথ্য বা নির্মোহ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ওই বার্তা দিয়েছিল। যেহেতু এটি অবশ্যই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হয়েছে সে পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার ওই বার্তাকে কাকতালীয় বলেই মনে হয়। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ এবং সেই প্রেক্ষাপটে ভূমিকায় কারা ছিল, বিষয়গুলো তারা অতটা বিবেচনায় নিয়ে বার্তা দেয়নি। তারা তাদের স্বার্থের জায়গা থেকে কথা বলেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘রাশিয়ার ওই ধরনের মন্তব্যের পেছনে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের যতটা না গুরুত্ব পেয়েছে, তার চেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির বৈরী সম্পর্ক। দেশটি সম্পর্কে ভীতি ছড়িয়ে দেয়ার একটা কৌশল হিসেবে ওই বার্তা তারা দিয়েছিল। ভারতের মধ্যেও এক ধরনের অতি আত্মবিশ্বাসী মনোভাব থাকার পাশাপাশি পরিস্থিতি মূল্যায়নে ঘাটতি ছিল। তাছাড়া রাশিয়ার বৈদেশিক নীতির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে অনেক দেশেরই। ফলে তাদের তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে ভেবেই সতর্কবার্তার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়নি।’
ওই সতর্কবার্তার আগেও বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার কূটনীতিকদের মধ্যে ব্যাপক বাগযুদ্ধ দেখা গেছে। নভেম্বরের শেষ দিকে ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টার অভিযোগ তুলে আরেকটি বক্তব্য রেখেছিলেন মারিয়া জাখারোভা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে রুশ মুখপাত্রের বক্তব্যকে ‘ক্ল্যাসিক রাশান প্রোপাগান্ডা’ বলে অভিহিত করেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন বিষয়ক কো-অর্ডিনেটর জন কিরবি।
সে সময় সাংবাদিকরা রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিয়ে রাশিয়ার তোলা অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে জন কিরবি বলেন, ‘নৌবাহিনীতে আমি এ ধরনের অভিযোগ শুনলে দুই সিলেবলের একটি শব্দে সেটার উত্তর দিতাম। তবে আপনার প্রশ্নের উত্তরে আমি সেটা বলছি না। এটি হলো ‘ক্ল্যাসিক রাশান প্রোপাগান্ডা’। এটাকে শুধুই রুশদের মিথ্যা প্রচারণা বলা যায়। তারাও জানে এটা মিথ্যা।’
এর পরদিন অর্থাৎ ২০২৩ সালের ৭ ডিসেম্বর রাজধানীর প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনায় ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন রুশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মন্টিটস্কির কাছে জন কিরবির ওই বক্তব্যের বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার মুখপাত্র ১০ বছর আগের ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তারা প্রতিটি দেশে যেকোনো বিপ্লবের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতে পারে ও তারা স্বীকৃতি দেয়। আমরা আপনাদের বলেছি যা আমরা অবশ্যই করব, আমরা এখানে যেকোনো বেআইনি কর্মের বিরুদ্ধে। এখানে আমেরিকান বা পশ্চিমা দেশগুলোর নেয়া যেকোনো পদক্ষেপ, নিষেধাজ্ঞার পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আমরা থাকব। দেখা যাক কী হয়। আমি আশা করি, এখানে এত কঠিন কিছু ঘটবে না।’
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভার ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দেয়া সতর্কবার্তা এবং ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকার রুশ দূতাবাসের মন্তব্য জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হয়। জবাবে দূতাবাস জানিয়েছে, এ বিষয়ে তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য নেই।