
ঢাকার মিটফোর্ড (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) হাসপাতালের সামনের সড়কে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে লাল চাঁদ সোহাগকে গত ৯ই জুলাই হত্যার ঘটনা নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন লেখায় দৈনিক যুগান্তর সাময়িকভাবে চাকরিচ্যুত করেছে পত্রিকাটির নিজস্ব প্রতিবেদক আবদুল্লাহ আল মামুনকে। তাকে এভাবে চাকরিচ্যুত করার ঘটনা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। সাংবাদিকরা বলছেন, গত বছরের ৫ই আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুতির ঘটনার ধারাবাহিকতার সবশেষ উদাহরণ আবদুল্লাহ আল মামুন। কিন্তু, কেন, কাদের চাপে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, এ প্রশ্নের কোনো উত্তর পাচ্ছেন না মামুনের অনেক সহকর্মী।
ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম তার সাম্প্রতিক এক কলামে লেখেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে ‘ডিজিএফআইকে ব্যবহার করে স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যমকেও ভয় দেখানো হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোতে বিজ্ঞাপন না দিতে বাধ্য করা হয় শেখ হাসিনার সরকারের নির্দেশে। এ অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ২০১৬ সাল থেকে টানা আট বছর বহাল ছিল।’ অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে গণমাধ্যমে ডিজিএফআইয়ের সেই দৌরাত্ম্য আর নেই বলে তিনি মনে করেন।
নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আওয়ামী লীগের স্বৈরতান্ত্রিক জমানার তুলনায় সাধারণভাবে অবশ্যই সম্প্রসারিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার সরকারকে সমালোচনা করার জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছেন। পত্রিকার সম্পাদকদের এখন আর আওয়ামী জমানার মতো বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে সাংবাদিকতা সম্পর্কে নসিহতমূলক বার্তা গ্রহণ করতে হয় না।'
বিশিষ্ট দুই সাংবাদিকের মন্তব্য থেকে ও অনুসন্ধান করে সুখবর ডটকম নিশ্চিত হয়েছে, সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনটি লেখার কারণে যুগান্তর থেকে আবদুল্লাহ আল মামুনকে চাকরিচ্যুত করার বিষয়ে কোনো গোয়েন্দা সংস্থার চাপ ছিল না। সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করার জের ধরে তিনজন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করার বিষয়ে মবের যে হুমকি ছিল, যুগান্তরের ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর তেমন কিছুও প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। কেন মামুনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, এ নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে নানা রহস্যঘেরা প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে। মিটফোর্ডে সোহাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখা মামুনের প্রতিবেদনটি গত ১২ই জুলাই যুগান্তরের প্রিন্টিং এবং অনলাইন সংস্করণে ‘আদিম বর্বরতা: পাথর নিক্ষেপে হত্যা- বিএনপির চাঁদার বলি ব্যবসায়ী সোহাগ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনটির বিষয়ে প্রতিবাদ জানায় বিএনপি। এ বিষয়ে যুগান্তরের সম্পাদককে আইনি নোটিশও পাঠায় দলটি। দলটির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামালের পাঠানো লিগ্যাল নোটিশে বলা হয়, 'প্রকাশিত সংবাদটি মিথ্যা, ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, মানহানিকর ও বানোয়াট।' প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে দলটির প্রতিবাদ যুগান্তরে ছাপা হয়। এতে প্রকাশিত সংবাদ প্রসঙ্গে সম্পাদকের বক্তব্য যোগ করে বলা হয়, 'প্রতিবেদনটি অসাবধানতাবশত ও অনিচ্ছাকৃত বিষয়। এজন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।' এরপরই সাময়িক চাকরিচ্যুতির নোটিশ পান আবদুল্লাহ আল মামুন। তবে নিয়ম অনুযায়ী প্রকাশিত সংবাদের সঙ্গে সাধারণত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের ব্যাখ্যা ও বক্তব্য ছাপানো হয়। প্রশ্ন উঠেছে, যুগান্তর মামুনকে সেই বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেয়নি কেন?
দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী মনে করেন, "ভারতে যদি ‘গদি সাংবাদিক’ হয়, বাংলাদেশে হবে ‘তেলবাজ সাংবাদিক’। অনেক সাংবাদিক বেতন পান না এটা যেমন ঠিক, আবার অনেকের বেতন প্রয়োজন হয় না, এটাও স্বীকার করতে হবে। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধেও কথা বলতে হবে। আমাদের আত্মসমালোচনাও করা উচিত।" ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল আলম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, 'দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অটোক্রেসির হাত থেকে এসে মবোক্রেসির দৌরাত্ম্যে পড়েছে। আগে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করত, এখন মব তৈরি করে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। মবের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে ভয় দেখানো হচ্ছে। মবের পেছনে আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী। সরকার সেটি দেখেও না দেখার ভান করছে।’
যুগান্তর থেকে মামুনের চাকরিচ্যুতির বিষয়ে সাংবাদিকরা বলছেন, দেশের গণমাধ্যমে সংকট গভীর হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে তাদের মধ্যে চাকরি হারানোর ভীতি তৈরি হয়েছে। কেন এ সংকট, তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। গত এক বছরের মধ্যে বেশ কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, দৈনিক পত্রিকার বিভিন্ন বিভাগে কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত বেতন হচ্ছে না। নিয়মিত বেতন না পাওয়া ও চাকরি হারানোর ভয়সহ চরম সংকটে রয়েছেন তারা। শুধু সাংবাদিকরাই নন, গণমাধ্যমে কর্মরত সবার একই অবস্থা। তাদের অভিযোগ, এ চাপ দেখা যায় না। সেটা দৈত্য বা ভূতের মতো সংবাদমাধ্যমের সবকিছুতে খড়গ হস্ত চালাচ্ছে।
জাগোনিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ও সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন জসিম যুগান্তরের সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের লিংক নিজের ফেসবুকের দেয়ালে শেয়ার করে এ প্রসঙ্গে লেখেন, 'এ প্রতিবেদনের কারণে যদি চাকরি যায়, তাহলে আমার সাবেক কর্মস্থল যুগান্তরের কারোর-ই চাকরি থাকার কথা নয়। আফসোস, গণমাধ্যমের জন্য। ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।' প্রসঙ্গত, সালাহ উদ্দিন জসিম একসময় যুগান্তরে কাজ করেছেন।
দৈনিক কালবেলায় কর্মরত ও সাংবাদিক সানাউল হক সানী ফেসবুক পোস্টে বলেন, 'যুগান্তর থেকে চাকরিচ্যুত আবদুল্লাহ আল মামুন ভাইকে পুনর্বহাল করার দাবি জানাচ্ছি। বাজে উদাহরণ তৈরি না করার অনুরোধ। চাকরি গেলে সম্পাদক–নিউজ এডিটরের যাবে, রিপোর্টারের কেন? রিপোর্টারের বাপের ক্ষমতা আছে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া একটা লাইন লেখার?'
ঢাকামেইলের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম মল্লিক লেখেন, 'সম্প্রতি মিটফোর্টে সোহাগ হত্যার ঘটনায় প্রতিবেদন লেখায় যুগান্তরের সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল মামুনকে যেভাবে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা উদ্বেগজনক। তাকে এ বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। কর্তৃপক্ষ অতি উৎসাহী হয়ে মামুনের রুটি রুজি নষ্ট করেছে। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।'
ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) সাবেক কার্যনির্বাহী সদস্য আবদুল্লাহ আল মামুনকে সাময়িক বরখাস্ত করায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সংগঠনটি। আজ বৃহস্পতিবার (১৭ই জুলাই) ক্র্যাবের সভাপতি মির্জা মেহেদী তমাল এবং সাধারণ সম্পাদক এম এম বাদশাহ্'সহ কার্যনির্বাহী কমিটির নেতারা এভাবে সাময়িক বরখাস্ত করার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।