
‘রাতে ঘুমাতে গেলাম। ঘুম থেকে উঠে হয়তো দেখব বরখাস্ত কিংবা বদলি হয়ে গেছি।’- নাম প্রকাশ না করার শর্তে এভাবেই বলছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক কর্মকর্তা। অপর এক কর্মকর্তার ভাষ্য, ‘সবাই ভয়ে আছি। কখন কার উপর কী শাস্তি নেমে আসে। কমবেশি সবাই তো আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। আবার নিজে সম্পৃক্ত না থাকলেও আমার ব্যাচের কর্মকর্তারা তো ছিলেন।’ অপর আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। সবকিছু থেকে দূরে আছি।’
বরখাস্ত, অব্যাহতি ও বদলি আতঙ্কে বুধবার (১৬ জুলাই) সারাবাংলার কাছে এভাবেই নিজেদের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন এনবিআরের কর্মকর্তারা।
এনবিআর বিলুপ্তি ও চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবির আন্দোলনে যুক্ত থাকার অপরাধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) একের পর এক বরখাস্ত হচ্ছেন কর্মকর্তারা। কেউ কেউ পেয়েছন অব্যাহতি। বদলি আতঙ্কও এনবিআরের অধীনস্থ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে। কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করার আদেশে বলা হচ্ছে, বদলির আদেশ ছিঁড়ে ফেলায় তাদের এই শাস্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তবে সবাই বদলির আদেশ ছিঁড়ে ফেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এদিকে যাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, তাদের কমবেশি সবাই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত এনবিআরের ২৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে চারজনকে। ১৬ জনের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। আর অন্দোলেনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বদলি করা হয়েছে অন্তত ১০০ জনকে। এরমধ্যে গেল ১ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের একজন কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ছাড়া, মঙ্গলবার বরখাস্ত করা হয়ছে ১৪জনকে। আর বুধবার বরখাস্ত হয়েছেন নয়জন।
বুধবার (১৬ জুলাই) দুপুরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এনবিআর ভবনে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের রুমে গেলে দেখা যায় তাদের মধ্যে এক ধরনের উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। সবার উদ্বেগ, বরখাস্তের তালিকায় নতুন করে কে যুক্ত হলেন! নতুন কোনো খবর আছে কিনা! আর কোনো তালিকা হয়েছে কি না! বিপদ কিংবা শাস্তিতে পড়ার ভয়ে কোনো কোনো কর্মকর্তা সাংবাদিকদেরও এড়িয়ে চলছেন। সহজে মুখ খুলছেন না তারা।
সূত্র বলছে, গণক্ষমা প্রার্থনা করলেও আন্দোলনে যুক্ত কর্মকর্তাদের ছাড় দিচ্ছেন না এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। সম্প্রতি আয়কর, কাস্টম ও ভ্যাট বিভাগের বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তারা চেয়ারম্যানের কাছে গণক্ষমা প্রার্থনা করেন। বিভিন্ন বৈঠকে তিনি জানান, অন্দোলনে যুক্তদের ছাড় দেওয়া হবে না। এনবিআরের বোর্ডে যুক্ত প্রায় সব কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছেন তিনি। এবং এ নিয়ে যাতে কেউ উচ্চবাচ্য না করেন, সে বিষয়েও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
বুধবার (১৬ জুলাই) দুপুর থেকেই খবর আসে এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব ও উপকর কমিশনার মুকিতুল হাসানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এনিবআর ভবনে পুলিশের একাধিক গাড়িও দেখা গেছে। মুকিতুল হাসান দুপুর পর্যন্ত অফিসেই ছিলেন। পরে দুইটার দিকে ভবন থেকে বের হয়ে যান। এর পর বিকেলের দিকে মুকিতুল হাসানকে বরখাস্ত হওয়ার খবর আসে। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় গোপন দলিল প্রকাশের অভিযোগ উঠেছে।
তাকে বরখাস্ত করার প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মুকিতুল হাসান রাষ্ট্রের অত্যন্ত গোপন দলিল প্রকাশপূর্বক চাকরির শৃঙ্খলা পরিপন্থী আচরণ করায় তার বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক বিভাগীয় কার্যধারা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তাকে সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ এর ৩৯ (১) ধারা অনুযায়ী এনবিআরের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপূর্বক সরকারি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের ট্যারিফ নিয়ে আলোচনার একটি গোপন নথি ধরে একজন সাংবাদিক একটি অনলাইন পোর্টালে সংবাদ প্রকাশ করে। সরকারের সেই গোপন নথি ওই সাংবাদিকের কাছে যাওয়ার কারণে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার নজরে পড়েন ওই কর্মকর্তা। এনবিআর চেয়ারম্যানের কক্ষে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে একজন সাংবাদিককে ওই নথি দেওয়ার তথ্য স্বীকার করেন শুল্কের এই কর্মকর্তা। তবে যিনি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, ওই ব্যক্তিকে কোন নথি তিনি দেননি। এসব অভিযোগে মুকিতুল হাসানের বিরুদ্ধে মামলার গুঞ্জনও শোনা যায়। তাকে গ্রেফতার করা হতে পারে এমন আতঙ্কও ছিল অনেকের মধ্যে।
বুধবার (১৬ জুলাই) মুকিতুল হাসান ছাড়াও সাতজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এর বাইরে কর অঞ্চ-১০ এর একজন কর্মকর্তাকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন,‘সাময়িক বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এনবিআর’র তদন্ত চলবে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তারা চূড়ান্ত বরখাস্ত হবেন। তবে কর্মকর্তা যদি এই আদেশে সন্তুষ্ট না হন, আপিলে যেতে পারবেন। ন্যয় বিচার পেতে হাইকোর্টের শরাণাপন্ন হতে পারবেন ওই ব্যক্তিরা।’
১৬ জুলাই বরখাস্ত সাতজন হলেন- কর অঞ্চল-২ এর কর পরিদর্শক লোকমান হোসেন, কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট ঢাকার কর পরিদর্শক নাজমুল হাসান ও আব্দুল্লাহ আল মামুন, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ছালেহা খাতুন সাথী ও রৌশনারা আক্তার, কর অঞ্চল-১৪ এর প্রধান সহকারী বিএম সবুজ ও কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট ঢাকা দক্ষিণ এর সিপাই সালেক খান। একই দিন রাষ্ট্রীয় গোপন নথি প্রকাশের অভিযোগে বরখাস্ত হন এনবিআরে দ্বিতীয় সচিব ও উপকর কমিশনার মুকিতুল হাসান। আর এনবিআর চেয়ারম্যানকে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে কটূক্তির অভিযোগে কর অঞ্চল-১০ এর নিরাপত্তা প্রহরী মো. সেলিম মিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার প্রজ্ঞাপন হলেও বুধবার সে খবর পাওয়া যায়।
১৫ জুলাই ১৪ জনকে সাময়িক বরখাস্তের খবর মেলে। এ দিন বিকেলে সাময়িক বরখাস্ত ছয় কর্মকর্তা হলেন— কর অঞ্চল-৮, ঢাকার অতিরিক্ত কর কমিশনার মির্জা আশিক রানা; উপ-কমিশনার ও এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব মো. শাহাদাত জামিল; মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এবং অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার; অতিরিক্ত কমিশনার ও ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক সিফাত-ই-মরিয়ম; ঢাকা উত্তর কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের রাজস্ব কর্মকর্তা সবুজ মিয়া এবং খুলনা ভ্যাট কমিশনারেটের রাজস্ব কর্মকর্তা শফিউল বশর।
এর মধ্যে অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন। এর আগে একই দিনে সকালে আরও আট কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। সকালের আদেশে বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তারা হলেন— কর অঞ্চল-২ এর যুগ্ম কর কমিশনার মাসুমা খাতুন, কর অঞ্চল-১৫ এর মুরাদ আহমদ, কুষ্টিয়া কর অঞ্চলের মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দিন, নোয়াখালী কর অঞ্চলের মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা ও কক্সবাজারের কর অঞ্চলের যুগ্ম কর কমিশনার আশরাফুল আলম প্রধান এবং উপ-কর কমিশনার শিহাবুল ইসলাম, রংপুরের নুসরাত জাহান শমী ও কুমিল্লার উপ-কর কমিশনার ইমাম তৌহিদ হাসান শাকিল।
এর আগে, ২ জুলাই এনবিআরের কর বিভাগের সদস্য মো. আলমগীর হোসেন, মূসক নীতির সদস্য ড. মো আবদুর রউফ, শুল্ক নীতির সদস্য হোসেন আহমদ ও বরিশালের কর কমিশনার মো. শব্বির আহমদকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল। গত ১ জুলাই রাতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে সরকার। বরখাস্তের পর তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) সংযুক্ত করা হয়।
প্রসঙ্গত, গত মে মাসে এনবিআর দুই ভাগ করে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব নীতি নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ করে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। রাতের আঁধারে জারি করা সেই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে কলম বিরতিসহ নানা কর্মসূচিতে নামেন এনবিআরের কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানটির সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ এর ব্যানের এসব আন্দোলন হয়। এক পর্যায়ে সরকার পিছু হটে।
গেল ২২ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অধ্যাদেশে ‘প্রয়োজনীয় সংশোধনী’ আনা হবে। আর সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান কাঠামোতেই চলবে এনবিআরের সব কাজ। এর মধ্যে সংস্থাটির কর্মীরা নানা অভিযোগ তুলে এনবিআর চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে নতুন করে আন্দোলনে নামেন এবং সংস্থার কার্যালয়ে তাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেন। দাবি আদায়ে ২৮ জুন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু করেন এনবিআরকর্মীরা। তাদের আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়ে আমদানি-রফতানিসহ এনবিআরের কার্যক্রম। পরের দিনও কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে সংস্থাটির সেবাকে ‘অত্যাবশ্যকীয়’ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
সংকট নিরসনে সেদিন এনবিআর কর্মীদের অবিলম্বে কর্মস্থলে ফেরার এবং ‘আইনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কার্যক্রম’ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়। পরে সংকট সমাধানে পাঁচ উপদেষ্টাকে নিয়ে কমিটি গঠন করার কথা জানায় সরকার। ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যস্থতায় আন্দোলনকারীদের প্লাটফর্ম এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ শাটডাউন কর্মসূচি তুলে নেয়। এর মধ্যে আন্দোলনের সামনের সারির নেতাদের ‘দুর্নীতির তথ্যানুসন্ধানে’ নামে দুদক। তিন দফায় ১৬ জনের তথ্যানুসন্ধান শুরুর তথ্য দেয় সংস্থাটি। আন্দোলন থামার পর এখন একের পর এক কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে এনবিআর।
সারাবাংলা