Image description

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরায় আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন সাতক্ষীরার দেবহাটার ছেলে আসিফ হাসান। তিনি ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। পড়তেন নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে। আহত আরেক সহযোদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হন তিনি।

শুধু আসিফই নয়, সাতক্ষীরার আরও তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন ছাত্র-জনতার সেই গণ-অভ্যুত্থানে। আহত হয়েছেন অন্তত ৯৭ জন। কিন্তু এক বছরেও তাদের হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। তদন্ত চলছে—এমনটাই বলা হচ্ছে বারবার; কিন্তু সেই তদন্ত কতটুকু এগোল তা জানে না পরিবার ও সহযোদ্ধারা।

সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলার আস্কারপুর গ্রামের ছেলে আসিফ হাসান (জন্ম ৫ আগস্ট ২০০৩)। নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। ঢাকা উত্তরার উত্তপ্ত সড়কে আন্দোলনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মোবাইলে বড় বোনকে বলেছিলেন— ‘আপা, আমি ঠিক আছি। পুলিশ শুধু ফাঁকা গুলি ছুড়ছে। আমাদের এক ভাই গুলিবিদ্ধ হয়েছে, ওকে পানি খাওয়াতে যাচ্ছি।’

সেই ভাইকে আর পানি খাওয়ানো হয়নি। সহযোদ্ধাকে টেনে তুলতে গিয়ে নিজেই গুলিবিদ্ধ হন আসিফ। কিছুক্ষণ পর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

dhakapost

আসিফের জমজ ভাই রাকিব হাসান সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের ছাত্র। তিনি বলেন— ‘পুলিশের গুলিতে ভাই মারা গেছে প্রায় এক বছর হয়ে গেছে। আমার ভাইয়ের অনুপস্থিতি বড়ই কষ্টদায়ক, বেদনার। সে ছাড়া আমাদের পরিবার ভালো নেই। সবাই আমার ভাইয়ের জন্য দোয়া করবেন।’

রাকিব হাসান বলেন, আইনি প্রক্রিয়ায় মামলার তদন্ত চলছে, পুলিশকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। বিচার হবে বলেছে। এখন আইনের বিষয়ে আমরা তো আর ভালো বলতে পারব না। ঢাকায় একজন মামলা করেছে। পরিবার থেকে মামলা করা হয়নি। পরিবার থেকে মামলা করলে লাশ তুলতে হবে, এজন্য মামলার দিকে যাওয়া হয়নি।

জুলাই আন্দোলনে সাতক্ষীরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত নাহিদ হাসান বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্ট সাতক্ষীরা যখন আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল, সেই মুহূর্তে দুপুর দেড়টার দিকে আমাদের কাছে খবর এলো যে, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে গেছে। ঠিক ওই সময় আমাদের ওপর পুলিশের একটি হামলা হয়। তার কিছুক্ষণ পরে আমাদের একটি মিছিল এসপি বাংলোর সামনে চলে যায়। ওখানে যাওয়ার পর কিছু বহিরাগত ছেলে আমাদের এসপি বাংলোতে ইট-পাটকেল মারে। ওখানে পুলিশ গুলি চালায়।’

‘আমি সামনে ছিলাম, পুলিশকে প্রোটেকশন দিচ্ছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়—সবাইকে সরিয়ে দেওয়ার পর পুলিশ আমাকে ফাঁকা পেয়ে শুট করে। বাঁ পায়ে গুলি লাগে, রাস্তায় ছিটকে পড়ি। সেখান থেকে আমার কয়েকজন সহকর্মী আমাকে তুলে নিয়ে একটি বাড়িতে নিয়ে যায়, সেখানে অজ্ঞান হয়ে যাই। পরে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১০ দিনের মতো চিকিৎসাধীন ছিলাম’, বলেন জুলাইযোদ্ধা নাহিদ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী মোহিনী তাবাসসুম বলেন, ‘সাতক্ষীরায় নিহত শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছি। তাদের সব সুবিধা ও অসুবিধায় পাশে থাকার চেষ্টা করি। আমরা চাই, সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে সর্বোচ্চ সম্মানটা দেওয়া হোক। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলার একটা জায়গা পেয়েছি, স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি—শুধুমাত্র তাদেরই আত্মত্যাগের বিনিময়ে। আমাদের সরকারের কাছে দাবি—নতুন বাংলাদেশে তারাই যেন সর্বোচ্চ সম্মানটুকু পায়।’

সাতক্ষীরায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক আরাফাত হোসাইন বলেন, ‘আপনারা জানেন যে আমাদের জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। আমাদের যে দাবি ছিল সেগুলো সবগুলো কিন্তু পূরণ হয়নি। এখন পর্যন্ত আমাদের শহীদ ভাইদের হত্যার বিচার হয়নি, আমাদের যারা আহত হয়েছেন তাদেরও বিচার হয়নি। জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে এখন পর্যন্ত বড় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র বিচারাধীন রয়েছে। এক বছর হয়ে গেছে কিন্তু এখনো আমাদের শহীদ পরিবারের কান্না শুকায়নি।’

এই সরকার থাকতে থাকতেই নির্বাচনের আগে সংস্কার এবং জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনে যারা ছিল, আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের যারা ছিল— আমরা সবার বিচার চাই। আমরা সবার ফাঁসি চাই। এটা সারা বিশ্বের মানুষ দেখতে চায়। শুধু আমাদের সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের সঙ্গে তারা প্রতারণা করেছে। তারা আত্মিকভাবে আমাদের দেশের ক্ষতি করেছে। আমরা এই বিচারের দাবি জানাচ্ছি। আমাদের এই আন্দোলন এখনও শেষ হয়নি।’

‘আপনারা জানেন জুলাই মাসব্যাপী সাতক্ষীরায়ও আমরা প্রোগ্রাম রেখেছি, কর্মসূচি রেখেছি। শহীদ ভাইদের স্মরণ এবং আহত ভাইদের চিকিৎসার জন্য তাদের কাছে যাওয়া, তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলা—এই ধরনের কর্মসূচি আমরা রেখেছি।’

আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিতে কর্মসূচির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বৃহৎ একটি কর্মসূচি রেখেছি ১৭ জুলাই। সেখানে দল-মত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দলের লোকজন জুলাইয়ের মতো মাঠে নেমে আসবে—যাতে করে আমাদের এই দাবি পূরণ হয়।’

এখন পর্যন্ত জুলাই ঘোষণাপত্র হয়নি, নতুন সংবিধান না হলে আবারো কিন্তু সেই ফ্যাসিবাদ চলে আসবে উল্লেখ করে আরাফাত হোসাইন বলেন, ‘একটা দেশ যখন ফ্যাসিবাদের মধ্যে থাকে, সেই সংবিধান যদি থাকে, সেই দেশ কিন্তু আর সামনে এগোতে পারে না। এজন্য নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। সেখানে ঘোষণাপত্র যুক্ত করতে হবে। আমাদের এই দাবি—যারা জুলাইযোদ্ধা রয়েছেন, এই ঘোষণাপত্র না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন আমরা চাই না, চাই না, চাই না। নির্বাচনের আগে ঘোষণাপত্র চাই।’