
এমন কোনো অপরাধ নেই, যা গত ১৫ বছরে তিনি করেননি। একজন ব্যবসায়ীর পরিচয়ে তিনি আসলে এক ভয়ংকর লুটেরা। একদিকে তাঁর নিরীহ চেহারা, অসুস্থতার ভান সারাক্ষণ, তিনি সব সময় রোগশোকে আক্রান্ত বলে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করতেন, অন্যদিকে ‘ভালোমানুষের’ মুখোশের আড়ালে তিনি এক ভূমিদস্যু, সন্ত্রাসী এবং মাদক কারবারি ও বহুরূপী প্রেমিক। রূপগঞ্জে এমন কোনো অপরাধ নেই যার সঙ্গে জড়িত নন গাজী। ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জকে বানিয়েছেন যেন অপরাধের অভয়ারণ্য। সেখানে রীতিমতো পারিবারিক রাজতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। আর সেই রাজতন্ত্রে অধীশ্বর হয়ে উঠেছিলেন গোলাম দস্তগীর গাজী। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের দুঃশাসনে রূপগঞ্জের মানুষের জীবন হয়েছিল আরও দুর্বিষহ। কারণ গোলাম দস্তগীর গাজী। ভূমি দখল, সন্ত্রাস, মাদক কারবার, মানুষ হত্যা-গুম, লুট, সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন সব অপরাধেরই তিনি যেন ‘কাজি’। তবে মজার ব্যাপার হলো, গোলাম দস্তগীর গাজীর এ রূপগঞ্জের রাজত্ব এককভাবে নয়, তিনি রূপগঞ্জকে যেন তাঁর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলেছিলেন; যে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে তিনি তাঁর স্ত্রী, ছেলে, তাঁর প্রেমিকা, এমনকি তাঁর এপিএস পর্যন্ত লুটপাটের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন-কে কত বেশি লুটপাট করেছেন গত ১৫ বছরে, তা হিসাব করে বের করা কষ্টসাধ্য বটে।
গত ১৫ বছর আওয়ামী স্বৈরশাসনে রূপগঞ্জে গাজীর কথার বাইরে কোনো কিছুই হতো না। গাজী হয়েছিলেন একক অধীশ্বর। তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে কোনো কিছুই করার ছিল না। তিনি যা বলতেন তা যদি না করা হতো তাহলে নেমে আসত অত্যাচারের খড়্গ। কারও কোনো টুঁশব্দ করার অধিকার ছিল না। এই গাজীর রাজত্বে সেখানকার আওয়ামী লীগও ‘গাজী লীগে’ পরিণত হয়েছিল। সেই আওয়ামী লীগের সব নেতৃত্ব-পদপদবি দখল করেছিলেন গাজী পরিবারের সদস্যরা। ফলে রূপগঞ্জে কায়েম হয়েছিল গাজী পরিবারের রাজতন্ত্র। রূপগঞ্জে একটি কথা প্রচলিত ছিল-যে কোনো অপরাধই হোক না কেন, সেটার সঙ্গে গাজী জড়িত আছেন।
আওয়ামী লীগের পতনের পর এখন গাজীর অবৈধ অর্থের অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক। গোলাম দস্তগীর গাজীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আওয়ামী সরকার থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে গোলাম দস্তগীর গাজী নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। অর্জিত এ সম্পদ তিনি হুন্ডি এবং আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন।
অভিযোগে বলা হয়, অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া গোলাম দস্তগীর গাজী যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে অর্থ পাচার করেছেন।
হুন্ডি ছাড়াও আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে তিনি ওই অর্থ পাচার করেন। পাচার করা অর্থে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও গড়েছেন। মালয়েশিয়ায় ‘মাই সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পের আওতায় তিনি সেখানে অর্থ পাচার করেছেন। সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে তাঁর বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ১৫ বছরে গোলাম দস্তগীর গাজীর সম্পদ ও ঋণ দুটিই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি মিলিয়ে বর্তমানে তিনি প্রায় ১ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকার মালিক। এ সম্পদের বিপরীতে তাঁর ব্যাংক ঋণ ৯৩৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে দেনা ১ হাজার ২২ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ১৫ বছরে গোলাম দস্তগীরের স্ত্রী রূপগঞ্জের তারাব পৌরসভার সাবেক মেয়র হাসিনা গাজীর অস্থাবর সম্পদ ২ কোটি ১৯ লাখ থেকে বেড়ে ৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা হয়েছে। ৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকার স্থাবর সম্পত্তি বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৬২ লাখ। হাসিনা গাজীর কাছে থাকা স্বর্ণালংকারের দাম দেখানো হয়েছে ২৪ হাজার টাকা। ১৫ বছরে পাটমন্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে ২৫ গুণ। সম্পদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ১৫ বছরে ব্যাংক ঋণ বেড়েছে ২১ গুণ।
১৫ বছর আগে গোলাম দস্তগীরের নগদ ৯৪ লাখ ১২ হাজার টাকা, ১৬ লাখ ৭ হাজার টাকা ব্যাংক জমা, সাড়ে ৪ কোটি টাকার কোম্পানি শেয়ার, ৩৯ লাখ ৮০ হাজার টাকার যানবাহনসহ মোট ৪৫ কোটি ৯৭ লাখ ৬০ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ ছিল। স্থাবর সম্পদ ছিল ১১ কোটি ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকার। স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে মোট ৫৭ কোটি ৭ লাখ ২০ হাজার টাকার সম্পদ ছিল। ১৫ বছর পর নগদ ৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ৬১ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে জমা, ২২ কোটি ৫ লাখ টাকার শেয়ার, ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকার যানবাহনসহ অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৩৮ কোটি ৮৬ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা।
অকৃষি জমি ও ভবন বাবদ স্থাবর সম্পদ আছে ১০৭ কোটি ৩১ লাখ টাকার। বর্তমানে স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে মোট ১ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকার সম্পদ আছে গোলাম দস্তগীরের, ২০০৮ সালের তুলনায় যা ২৫ গুণ বেশি। সম্পদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঋণও বেড়েছে। ২০০৮ সালে তাঁর ব্যাংক ঋণ ছিল ৪৩ কোটি ৩৫ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। বর্তমানে তাঁর ব্যাংক ঋণ ৯৩৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এ হিসাবে সাবেক পাটমন্ত্রীর ঋণ বেড়েছে ২১ গুণ। আগস্টের পর থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় গাজী এখন ঋণখেলাপি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব সম্পদ বিবরণীর বাইরে রয়েছে গাজীর বিপুল অবৈধ সম্পদ।
অস্ত্রবাজ, সন্ত্রাসীদের লালনপালন থেকে শুরু করে এলাকায় মাদক কারবার, সন্ত্রাস, খুন-গুম, জবরদখল সবকিছুতে আছে তাঁর নাম। এসব অবৈধ কর্মকা ই ছিল বিগত ১৫ বছর গাজীর কালো টাকার প্রধান উৎস। আর এসব অপরাধের নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ রাখার জন্য গাজী গড়ে তুলেছিলেন বিশেষ বাহিনী।
গাজীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার দুঃসাহস দেখালে দেওয়া হতো মামলা, করা হতো হামলা আর শারীরিক নির্যাতন। জমি দখল ও সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে খুন-গুমের মতো স্পর্শকাতর অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে।
১৫ বছর যত সরকারি স্থাপনা রাষ্ট্রীয় খরচে গড়ে তোলা হয়েছে তার প্রায় সবই হয়েছে গাজীর নামে। সাধারণ মানুষের আবাদি জমিতে গাজী স্টেডিয়ামের সাইনবোর্ড বসিয়ে বালু ভরাট করে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রির অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। কোথাও আবাদি জমি ও বসতভিটা দখল করে গাজী গ্রুপের বিভিন্ন কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে। করেছেন আবাসন প্রকল্পও। তাঁর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকা ছাড়তে হয়েছে অনেক সংখ্যালঘু পরিবারকেও।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রূপগঞ্জের কেয়ারিয়া, পর্শি, বাড়িয়াছনি, কুমারপাড়ায় কয়েক শ হিন্দু পরিবারের বসবাস। সেখানকার ৮০ শতাংশ হিন্দুর জমি জিপার্ক (গাজী পার্ক) নামে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরাও করে বালু ভরাট করেছেন তিনি। জিপার্কের এ জায়গা জরবদখলের দায়িত্বে ছিলেন বাঘবেড় সিটি মার্কেট এলাকার ভূমিদস্যু ইমন হাসান খোকন। জানা গেছে, খোকন মন্ত্রী গাজীর পালিত ভূমিদস্যুদের একজন।
রূপগঞ্জের খাদুন এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে গাজী টায়ার ফ্যাক্টরি। এ ফ্যাক্টরির প্রায় ৮০ শতাংশ জমিই জোরপূর্বক দখল করা হয়েছে। আয়েত আলী ভুঁইয়ার ছেলে হাজি আমজাদ আলী ভুঁইয়ার ১৯ বিঘা ৮ শতাংশ, হাজি আবদুল হাইয়ের ৪ বিঘা, মোবারক হোসেনের দেড় বিঘা, আবদুল বারী ভুঁইয়ার ২ বিঘা, নূর মোহাম্মদের ১ বিঘা, ইসমাইল খাঁর ৪ বিঘা, সিরাজ খাঁর ৪-৫ বিঘা, শাহ আলমের প্রায় ৭০ শতাংশ, জুলহাস ভুঁইয়ার ৭১ শতাংশ ও আপেল মাহমুদের আড়াই বিঘা জমি জোরপূর্বক দখল করে খাদুনে গাজী টায়ার ফ্যাক্টরি তৈরি করা হয়।
পাশা গ্রুপের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ অভিযোগ করেন, এ ফ্যাক্টরির স্টাফ কোয়ার্টার বানানো হয়েছে পাশা গ্রুপের ১৩৯ শতাংশ জমি ওপর। পাশা গ্রুপের পাঁচ তলা ভবনসহ জমি দখলের অভিযোগে গাজীর বিরুদ্ধে মামলাও করে পাশা গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানের জমি রক্ষা করতে গিয়ে নির্মম হামলার শিকার হন খোরশেদ আলম।
আওয়ামী লীগের পদ এবং মন্ত্রিত্বের প্রভাব খাটিয়ে উপজেলার বিরাব, কাঞ্চন, ভালুকাব, টেংরারটেক, পোনাব, আমলাব, কেশরাব, আধুরিয়া, পূর্বগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় দেড় হাজার বিঘা হিন্দু-মুসলিমের মালিকানা ও খাসজমি দখলে নিয়েছেন গোলাম দস্তগীর গাজী ও তাঁর পরিবার।
শুধু জমি দখলই নয়, মাদক কারবার এ এলাকায় বড় সমস্যা। তাতেও ছিল গাজীর নিয়ন্ত্রণ। ধর্ষণ এবং খুনের পেছনেও রয়েছে এ বাহিনী। বৈধ-অবৈধ অস্ত্র আর মাদকের ডিপোয় পরিণত হয়েছে রূপগঞ্জ। আর এসব নিয়ন্ত্রণ করেন মন্ত্রিপুত্র পাপ্পা ও মন্ত্রীর এপিএস দাদা এমদাদ। গাজীর স্ত্রীও ক্ষমতার দাপটে রূপগঞ্জে যা খুশি করেছেন। এ ছাড়া গাজীর কথিত প্রেমিকা নীলাও গাজীর দাপটে রূপগঞ্জে বিস্তার করেছিলেন অপরাধীদের সাম্রাজ্য।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন গাজীর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে এলাকাবাসী। তারা বলছে, গোলাম দস্তগীর গাজীর দীর্ঘ সময়ে ভূমিদস্যুতা, মাদক কারবারসহ খুন-গুমের কারণে রূপগঞ্জ এখন অপরাধের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত।
দলীয় পদপদবি বাগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও কম যায়নি গাজী পরিবার। প্রভাব খাটিয়ে একই পরিবারের বাবা মন্ত্রী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, ছেলে সিনিয়র সহসভাপতি, মা উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌরসভার মেয়র পদ দখল করেছিলেন। গাজী, তাঁর পুত্র, স্ত্রী এবং বান্ধবীর মধ্যে রূপগঞ্জে সন্ত্রাস, মাদক কারবার এবং ভূমি দখলের প্রতিযোগিতা ছিল সবার জানা। আর এসব অপরাধ নির্বিঘ্নে করতে গড়ে তুলেছিলেন ‘গাজীবাহিনী’।
৫ আগস্টের পর গোলাম দস্তগীর গাজী গ্রেপ্তার হলেও তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনীর অনেকেই এখনো এলাকায়। এরা এখনো গাজী পরিবারের অপরাধ সাম্রাজ চালাচ্ছেন।
সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন