Image description

‘মা, আমি মারা গেলে তুমি শহিদের মা হবে’-এটাই ছিল পঞ্চগড়ের তরুণ সাগর ইসলামের শেষ কথা। নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বুকে ধারণ করে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মাত্র ১৯ বছরের এই স্বপ্নবাজ তরুণ। তবে স্বপ্ন দেখা হলেও, সেই স্বপ্ন বাস্তবে দেখা হয়নি-পুলিশের গুলিতে ঝরে সাগরের প্রাণ। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে প্রাণ দেয়া পঞ্চগড়ের পাঁচ শহিদের মধ্যে একজন ছিলেন সাগর।

 

সাগরের জন্ম পঞ্চগড় সদর উপজেলার চাকলাহাট ইউনিয়নের নায়েক পাড়ায়। বাবা রবিউল ইসলাম ও মা সখিনা আক্তারের ঘরে জন্ম নেয়া সাগর শৈশবেই হারান পারিবারিক বন্ধন। বয়স যখন মাত্র ১০ মাস, তখনই মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর মা তাকে নিয়ে ফিরে আসেন একই ইউনিয়নের সর্দার পাড়ায় দিনমজুর নানা-নানির সংসারে। কিছুদিনের মধ্যেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন মা সখিনা। সেই থেকে সংগ্রামী জীবন শুরু হয় সাগরের।

নানা সপিজ উদ্দিন মারা যান চার বছর আগে। এরপর একমাত্র নানিকে নিয়ে মানুষের বাড়িতে দিনমজুরির কাজ করতে শুরু করেন সাগর। অভাব-অনটনের মাঝেও দমে যাননি। শিক্ষা জীবনেও ছিল তার লড়াই। ২০২২ সালে স্থানীয় একটি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে পাড়ি জমান ঢাকায়। মামা হাসিবুল ইসলামের সঙ্গে মেরুল বাড্ডার এক ভাড়া বাসায় থাকতেন এবং কাজ করতেন একটি ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে।

ঢাকায় থেকেও দেশের রাজনীতির খোঁজ রাখতেন সাগর। স্বপ্ন দেখতেন পরিবর্তনের, বৈষম্যহীন এক সমাজের। সেই স্বপ্নই তাকে টেনে নেয় আন্দোলনের মিছিলে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিকেলে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ছাত্র-জনতার আনন্দ মিছিলে অংশ নেন তিনি। মেরুল বাড্ডা এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হন সাগর। স্থানীয়রা তাকে দ্রুত মুগদা হাসপাতালে নিলে রাতেই চিকিৎসাধীন মৃত্যু হয় তার। রাত ১১টার দিকে সাগরের নিথর দেহ খুঁজে পান স্বজনেরা। পরদিন ৬ আগস্ট মরদেহ নিয়ে আসা হয় চিরচেনা সেই সর্দার পাড়ায়। পরে সবার সিদ্ধান্তে সাগরকে দাফন করা হয় তার বাবার গ্রাম নায়েক পাড়ার মসজিদের পাশে।

সম্প্রতি সর্দার পাড়ায় সাগরের নানির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিনের তৈরি ছোট ঘরটির পাশেই দাঁড়ানো নতুন একটি পাকা ঘর। সম্প্রতি ঘরটি শহিদ সাগরের মা-নানির ঠাঁইয়ের জন্য করে দিয়েছে জেলা পরিষদ। এডিপি খাত থেকে ‘গৃহ নির্মাণ প্রকল্প’-এর আওতায় এই পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ঘরটি নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। ঈদের পর সেই ঘরে ঠাঁই নিয়েছেন সাগরের মা-নানি। 

সগরের মা বলেন, ‘আমি ঘটনার দিন সাগরকে বলেছিলাম বাবা তুমি মিছিলে যেও না, সাগর তখন তার মাকে বলেছিল মা তুমি চিন্তা করো না,আমি মারা গেলে তুমি শহিদের মা হবে। মৃত্যুর আগে মায়ের সঙ্গে এটাই ছিল সাগরের শেষ কথা। সাগরের মা বলেন আমি অনেক কষ্টে সাগরকে গড়ে তুলেছি। যখন সাগরের বয়স ৮ মাস তখন তার বাবার সঙ্গে আমার বিচ্ছেদ হয়। কখনো সন্তানের খোঁজ করেনি সে। এখন সাগর মারা যাওয়ার পর অনুদানের টাকার ভাগ নিতে এসেছে সে।’

কথা হয় সাগরের নানি হালিমা খাতুনের সঙ্গে। যেন স্মৃতি জড়ানো প্রতিটি মুহূর্ত আজ এই বৃদ্ধার চোখে অশ্রু হয়ে ঝরছে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, সাগর ছোট থেকেই কষ্ট করে বড় হয়েছে। ওর বাবা-মা আলাদা হয়ে যাওয়ার পর আমি আর ওর নানা ওকে কোলে পিঠে করে বড় করেছি। বছর চারেক আগে ওর নানাও চলে গেলো। একা হাতে সংসার সামলাতে হয়েছে। সাগর তখন আমার সঙ্গে মানুষের বাড়ি কাজ করতে যেতো। কখনো অভিযোগ করতো না। বলতো- মায়ের চিকিৎসা করাতে হবে, তোমাকেও আর কষ্ট করতে দেবো না। নানি, আমি বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, ঈদের সময় সাগর আমাকে কত কিছু এনে দিতো, আর কখনোই দিবে না। প্রতিবছর, ঈদ আসবে- মানুষজনের ঘরে আনন্দ হবে; কিন্তু আমার সাগর আর আসবে না। আমার আদরের নাতিটা কি করে এত তাড়াতাড়ি চলে গেলো! 

সাগরের মামা হাসিবুল ইসলাম বলেন, সাগর আমার সঙ্গেই থাকতো ঢাকার মেরুল বাড্ডায়। আমরা একসঙ্গে খেতাম, ঘুমাতাম, কথা বলতাম। আমি অনেকবার ওকে বলেছি, তুই এসব থেকে দূরে থাক, কিন্তু শুনেনি। ৫ আগস্ট সকালে আমাকে বলেই বের হলো, আমি অনেক বুঝিয়েছি, কিন্তু না, ওর তখন শুধু একটা জেদ। বিকেলে খবর এল গুলি লেগেছে। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পঞ্চগড় সমন্বয়ক ফজলে রাব্বী বলেন, শহিদ সাগর ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের জীবন দিয়ে আমাদের কাছে ঋণ রেখে গেছেন। শহিদ পরিবারগুলোর পাশে আমরা আছি, থাকবো। রাষ্ট্রের সকল সুবিধাসহ অসহায় পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে বিত্তবান মানুষের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. সাবেত আলী বলেন, পঞ্চগড়ে শহিদ সাগরসহ পাঁচজন নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নে প্রাণ দিয়েছেন। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। প্রশাসন সবসময় এসব পরিবারের পুনর্বাসনে কাজ করছে। 

জানা গেছে, সাগর শহিদ হওয়ার পর বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে তার পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয় পত্র, জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পরিবারটি পেয়েছে ৫ লাখ টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দিয়েছে এক লাখ টাকা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ পঞ্চগড়ে শীতবস্ত্র বিতরণে এসে দিয়েছেন আরও ২ লাখ টাকা।