Image description

ঢাকার কেরানীগঞ্জে সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর প্রিয় প্রাঙ্গণ হাউজিং ও তার নানা অপকর্মের সহযোগী নুর আলম ওরফে গোল্ডেন আলমকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে।

তাদের মধ্যে রয়েছেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরী, ঢাকা জেলা কৃষক দলের সভাপতি জুয়েল মেম্বার, ঢাকা জেলা ছাত্রদলের সভাপতি পাভেল মোল্লা, তেঘরিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি খোরশেদ জমিদার ও তেঘরিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি সেলিম মোল্লা । তারা নিয়মিত চাঁদা নিয়ে বিপুর প্রিয়প্রাঙ্গণ ও নুর আলমকে এলাকায় থাকতে দিয়েছেন। সুযোগ দিয়েছেন প্রিয় প্রাঙ্গণের প্লট রক্ষণাবেক্ষণ, বিক্রি ও হস্তান্তর করার।

সরেজমিনে জানা যায়, ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের রাজেন্দ্রপুরে সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর আলোচিত প্রিয় প্রাঙ্গণ হাউজিং । ১৯৯৭ সালে এর যাত্রা শুরু হলেও আওয়ামী শাসনের ১৫ বছরে সেখানে জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার বিঘা। এর ৩ হাজার বিঘা জমির জোগান দেন নুর আলম ওরফে গোল্ডেন আলম।

যে নুর আলমের একসময় কিছুই ছিল না; এলাকাবাসী সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে তাকে দাওয়াত দিত না। সেই নুর আলম ওরফে গোল্ডেন আলম এখন কয়েক হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক। রয়েছে একাধিক আলিশান বহুতল ভবন, মার্কেট, ব্যাংক, বিমা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ব্রিকফিল্ড, ভেকু ব্যবসা, মাটির ব্যবসা, হাউজিং কোম্পানি, রেন্টাল কুইক পাওয়ার প্যাকসহ এক হাজার বিঘা জমি। প্রিয় প্রাঙ্গণ হাউজিংয়ে আছে ২৫টি প্লট। ঢাকার দোহার রোডে ৩০০ বিঘাসহ কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে একাধিক হাউজিং ব্যবসা। নিজের বাড়িতে গোল্ডেন রঙের বহুতল ভবন বানিয়ে হয়েছেন ‘গোল্ডেন আলম’।

জমি কিনেছেন স্ত্রী পারভীন বেগম, শাশুড়ি আনু বেগম ও শ্বশুর আলমের নামেও। যে শ্বশুর বুড়িগঙ্গায় নৌকা বেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন, সেই শ্বশুরের বাড়িতেও এখন সাততলা ভবন। মাদকাসক্ত শ্যালক পাভেলকে পাঠিয়েছেন সৌদি আরবে। তবে এসব সম্পদের পুরোটাই গোপন করেছেন সরকারের রাজস্ব খাতায়।

এর বাইরে কুচিয়ামোড়া ফেরিঘাটে চরগুলগুলিয়া মৌজায় ১৮২০ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত ১০০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট, যা ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছেন-সেটিও রাজস্ব ফাইলে উল্লেখ করা হয়নি । ওই পাওয়ার প্লান্ট থেকে নুর আলম জমি ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে পান ৩৬ লাখ টাকা এবং অগ্রিম নিয়েছেন ১০ কোটি টাকা। জাবেদ আলী টাওয়ারে ৫টি ব্যাংকের শাখা ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসসহ শতাধিক দোকান এবং প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক ভাড়া পাচ্ছেন ৮ লাখ টাকা।

এছাড়াও মরিচাশুর টিকরপুর আগলায় ৭০ বিঘা জমি, নবাবগঞ্জের ভাঙ্গাভিটায় ১০০ বিঘা, নবাবগঞ্জ শহরে ১০০ শতাংশ, বাঘৈর মৌজায় ২০ শতাংশ, নোয়ার্দায় ২০০ শতাংশ, প্রিয় প্রাঙ্গণে ২৫টি প্লট, সোশ্যাল ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, আল-আরাফাহ্‌ ব্যাংকের হাসনাবাদ ও রাজেন্দ্রপুরের একাধিক শাখায় শতকোটি টাকার লেনদেন থাকলেও তিনি তার রাজস্ব ফাইলে উল্লেখ করেননি।

এলাকাবাসী জানায়, ২০০৭ সালে নুর আলম ছিলেন স্থানীয় কোরবানের ইটভাটার ম্যানেজার। তখন এক কুয়েতপ্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ার কারণে এলাকাবাসী আলমকে সমাজ থেকে আলাদা করে দেয়। সেই আলম এখন হাজার কোটি টাকার মালিক।

জানা যায়, নুর আলম মুজিব আদর্শে বিশ্বাসী এবং কেরানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা । তেঘরিয়া ইউনিয়নের বাঘৈর আইলাপাড়া গ্রামে তার বসতভিটা। পিতার নাম জাবেদ আলী। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর পিএস জসিমের মাধ্যমে প্রিয় প্রাঙ্গণ হাউজিংয়ে জমির দালালি তার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটায়। জাল দলিল, হিন্দু সম্পত্তি দখল ও খাড়া দলিলে পারদর্শী নুর আলম অল্পদিনেই বিপুর আস্থা অর্জন করেন।

বিভিন্ন গরিব মানুষের সম্পত্তি, হিন্দু সম্পত্তি ও ভিপি সম্পত্তির নকল দলিলের মাধ্যমে প্রিয় প্রাঙ্গণে ৩ হাজার বিঘা জমি এনে দেন নুর আলম। তার বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য হিন্দু ও মন্দিরের সম্পত্তি দখলের অভিযোগ।

রাজেন্দ্রপুর রাধাগোবিন্দ বিগৃহ জিও মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ চন্দ্র দাস জানান, তাদের মন্দিরের নামে স্থানীয় সুভাসিনী ও সুভাসিনীর ছেলে নন্দী লাল সাহার দানপত্র করে দেওয়া ৭৪ শতাংশ জমি নুর আলম জাল দলিল করে দখল করে নিয়েছেন।

কালীগঞ্জের বাসিন্দা মেন্ডু মিয়ার ছেলে আরিফ জানান, গোল্ডেন আলম তাদের ৫ বিঘা জমি জবরদখল করে জাল দলিলের মাধ্যমে প্রিয় প্রাঙ্গণ হাউজিংয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন। তারা এখনো পর্যন্ত জমির টাকা পাননি। গুলশানের বাসিন্দা সারোয়ার হোসেন বাচ্চু মিয়া জানান, বাঘৈর মৌজায় তার ৭০ শতাংশ জমি পিস্তল ঠেকিয়ে দখল করেছেন গোল্ডেন আলম।

এছাড়া তার বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলিবর্ষণ, ২০১৩ সালের ৫ মে রাজেন্দ্রপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় হেফাজতে ইসলামের মিছিলে গুলিবর্ষণের অভিযোগ রয়েছে।

এ ব্যাপারে গোল্ডেন আলমের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতা ও ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের মিছিলে গুলি করার কথা অস্বীকার করেন। তবে কুয়েতপ্রবাসী একজনের স্ত্রীর শ্লীলতাহানি, রাজস্ব ফাঁকি, আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের পাওয়ার প্লান্টসহ বিপুর একাধিক ব্যবসার পার্টনার, প্রিয় প্রাঙ্গণে ২৫টি প্লট ও একাধিক ব্যাংকে আয়বহির্ভূত লেনদেনের ব্যাপারে তিনি বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

গোল্ডেন আলমকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে ঢাকা জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক জুয়েল মেম্বার, ঢাকা জেলা দক্ষিণ ছাত্রদলের সভাপতি পাভেল মোল্লা ও তেগুরিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি খোরশেদ জমিদার, যুবদলের সভাপতি সেলিম মোল্লাসহ স্থানীয় একাধিক বিএনপি নেতা এজন্য থানা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরীকে দায়ী করেন। তাদের মতে, নেত্রী ম্যানেজ না হলে নুর আলমের মতো দুর্ধর্ষ ভূমিদস্যু এলাকায় অবাধে বসবাস করে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারত না।

ঢাকা জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক জুয়েল মেম্বার বলেন, নুর আলম আওয়ামী লীগ করেন। তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। নুর আলম কেন, আমার কোনো আত্মীয়-স্বজনও যদি আওয়ামী লীগ করে, তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। ঢাকা জেলা দক্ষিণ ছাত্রদলের সভাপতি পাভেল মোল্লা বলেন, নুর আলম আমার ভাগ্নি জামাই। এছাড়া তার সঙ্গে আমার কোনো আর্থিক লেনদেন নেই।

তেঘরিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি খোরশেদ জমিদার বলেন, নুর আলম ওরফে গোল্ডেন আলম যুবদল নেতা সেলিম মোল্লা ও ছাত্রদল নেতা পাভেল মোল্লার আত্মীয়। তারা দুজন গোল্ডেন আলমের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নেয়। তবে সেলিম মোল্লা বলেছেন, তিনি গোল্ডেন আলমের উকিলশ্বশুর । তার বাবা নুর আলমের কাছে জমি বিক্রির ১০ লাখ টাকা পাওনা আছে। সে টাকাও দেয়নি। পারিবারিক লেনদেন ছাড়া নুর আলমের সঙ্গে তার কোনো ধরনের চাঁদার লেনদেন নেই।

এ ব্যাপারে বক্তব্য নেওয়ার জন্য দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা বিএনপির সভাপতি নিপুণ রায় চৌধুরীর নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।