
বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় খোলার বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। গত বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত এ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই খসড়ায় জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস যদি আর কোনও মন্তব্য না করে, বা পাল্টা প্রস্তাব না দেয়, তবে তাদের সঙ্গে চুক্তি করার উদ্যোগ নেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস খোলার সিদ্ধান্তের বিষয়ে সতর্ক মতামত ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, মানবাধিকার সুরক্ষা ও প্রসারে জাতিসংঘ অনেক বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে কাজ করে আসছে। তবে কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেগুলো স্পর্শকাতর হতে পারে। অপরদিকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অর্জনের সক্ষমতা সব দেশের সমান নয় এবং সে লক্ষ্যে নিয়োজিত প্রয়াসের মাত্রাও ভিন্ন হতে পারে। সর্বোপরি মানবাধিকার সম্পর্কে সমাজে সব পর্যায়ে সচেতনতা ও সুশিক্ষা কতটুকু, তার ওপর নির্ভর করে অধিকার রক্ষায় সাফল্য। সে প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ মানবাধিকারের অফিসের করণীয় বা তার ম্যান্ডেটের চরিত্র ও পরিধি নির্ধারণ সব অংশীজনের জ্ঞাতসারে হলেই ভালো হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ছোট কিন্তু প্রভাবশালীর গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ নেই এবং বিদেশিদের পরামর্শের বদলে অভ্যন্তরীণভাবে সমাধান বাংলাদেশের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে।
জেনেভায় সাবেক রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অফিস খোলা সংক্রান্ত চুক্তির উদ্দেশ্য, কর্মপরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে সহায়ক উপাদান সম্পর্কে স্বচ্ছতা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এগুলো সম্পর্কে না জেনে মন্তব্য করা বাঞ্ছনীয় নয়।’
তিনি বলেন, ‘তবে সাধারণ ধারণা থেকে বলা যায়, এখানে অফিস খোলার প্রধান উদ্দেশ্য হতে পারে— যেসব ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বা হচ্ছে এবং অধিকার রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে ধারণা নেই—সে অপূর্ণতা নিরসনে এ অফিস ভূমিকা রাখতে পারে।’
জানতে চাইলে জেনেভায় কাজ করা সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. সুফিউর রহমান বলেন, ‘মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও চর্চার বিভিন্ন বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকারে আবদ্ধ বাংলাদেশ। কিন্তু এসবের অনেকগুলোর বাস্তবায়ন কোনও কোনও ক্ষেত্রে সম্ভব হবে না।’
সমাজ কতটুকু প্রস্তুত, পরিপক্ব বা সুশিক্ষা, প্রয়োগের সক্ষমতাসহ বিভিন্ন উপাদানের গুণগত মানের ওপর নির্ভর করে—একটি সমাজে মানবাধিকার-বিষয়ক ধারণার ব্যাপ্তি ও চর্চা কতটুকু হবে বলে তিনি জানান।
তিনি জানান, ছোট কিন্তু প্রভাবশালী গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, মৃত্যুদণ্ড প্রথা থাকবে কিনা বা সমকামিতার আইনগত বৈধতা দেওয়া হবে কিনা, বা উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমঅধিকার থাকবে কিনা— এ ধরনের অনেক স্পর্শকাতর বিষয় বৃহত্তর অভ্যন্তরীণ আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা হওয়া দরকার।’
স্পর্শকাতর মানবাধিকার বিষয়
স্পর্শকাতর মানবাধিকার বিষয়গুলো নিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন মেকানিজম প্রচারণা চালায়, চর্চার পরামর্শ দেয় —যা বাংলাদেশের জন্য স্পর্শকাতর হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে মৃত্যুদণ্ড রহিত করা, সমকামিতার বৈধতা, সর্বজনীন শিক্ষা (যৌন শিক্ষাসহ), রিপ্রোডাক্টিভি হেলথ বা গর্ভধারণের বিষয়ে নারীদের পূর্ণ অধিকারসহ (গর্ভপাত করার অধিকার) অন্যান্য বিষয়।
এছাড়া রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘আদিবাসী’ বিষয়ক ধারণার ভুল ব্যাখ্যা বাংলাদেশের জন্য স্পর্শকাতর।
মানবাধিকার শিক্ষা
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেটির চর্চা সামাজিক কাঠামোর সবচেয়ে নিম্নস্তর থেকে শুরু করতে হবে। মানবাধিকার চর্চা পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। অর্থাৎ পিতা-মাতা সন্তানের সঙ্গে ঠিক ব্যবহার করছেন কিনা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথাযথ সম্পর্ক রক্ষা করা এবং কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের সঙ্গে সুন্দর পরিবেশে কাজ করাও মানবাধিকারের অংশ। বৃহত্তর স্তরে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হলে সেটি গোটা সমাজে বড় ধরনের প্রভাব রাখে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান বলেন, ‘মানবাধিকার শিক্ষা এমন একটি কনসেপ্ট, যা সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক মানসিকতা তৈরি করে। আর মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে ‘হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার’ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। মোটের ওপরে বাংলাদেশের সমাজ কতটুকু মানবাধিকার সচেতন হবে, তা এ বিষয়গুলোর ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে।’
অধিকার সম্পর্কে সামাজিক প্রস্তুতি ও তা রক্ষার প্রয়োজনীয়তার একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে আগে তথ্য অধিকার সম্বন্ধে সচেতনতা তেমন ছিল না। কিন্তু সার্বিক উন্নয়নে এর প্রয়োজনীয়তার নিরিখে তথ্য অধিকার আইন তৈরি হওয়ার পর সরকারি অফিসগুলোতে একজন তথ্য অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আইনানুগ উপায়ে তথ্য প্রদানের জন্য। এটি সম্পূর্ণভাবে কার্যকর না হলেও এর উপযোগিতা স্পষ্ট।’
একই ধরনের মনোভাব পোষণ করে মো. সুফিউর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপ্তি নিয়ে সমাজে বড় ধরনের আলোচনা ও বিতর্ক হওয়া দরকার। সবার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাপ্তি নির্ধারণ করা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করা বা সমকামিতা মেনে নেওয়া, বা উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমঅধিকার– এ বিষয়গুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এ ধরনের অনেক প্রশ্নে অভ্যন্তরীণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না করে জাতিসংঘকে এখানে কাজ করতে বড় ধরনের ম্যান্ডেট দিলে সেটি সমাজে বিতর্ক ও বিপত্তি তৈরি করতে পারে। আশা করি এ ধরনের বিষয়গুলো নতুন খোলা অফিসের কার্যপরিধির বাইরে থাকবে।’
হোম গ্রোন সলিউশন
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ঘরোয়া সমাধান (হোম গ্রোন সলিউশন) দরকার। প্রচলিত মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশ একমত। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন।
সাবেক রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান বলেন, ‘মানবাধিকারের সুরক্ষা ও প্রসার একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়। এটি নির্ধারণের দায়িত্বও সেই পর্যায়ের নেতৃত্বের ওপর ন্যস্ত থাকাই যৌক্তিক। সেইসঙ্গে বাস্তবায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ পরিকাঠামো এবং সক্ষমতা তৈরি করা প্রয়োজন। অতীতের অপূর্ণতার প্রেক্ষাপটে তাই পুনর্গঠিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে একটি কার্যকর মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব এবং সেদিকে নজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি।’
এ বিষয়ে সুফিউর রহমান বলেন, ‘শক্তিশালী জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নারী ও শিশু কমিশন, সংখ্যালঘু কমিশন, শ্রম কমিশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির অগ্রগতি সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেসব ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, তার অর্ধেকের বেশি হয় নারী-শিশু, সংখ্যালঘু এবং শ্রম বিষয়ক। এসব বিষয়ে পৃথক কমিশন থাকলে এবং তাদের পরামর্শ রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বিবেচনায় নিলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’