
কর্মী , শিক্ষার্থী ও সরকারি - বেসরকারি প্রায় সব ক্ষেত্রের পেশাজীবীদের জন্য বিদেশের ভিসা পাওয়া দিন দিন জটিল হচ্ছে । বিদেশি দূতাবাসগুলোয় জমা হওয়া ভিসার অধিকাংশ আবেদন নাকচ হচ্ছে । এ ছাড়া আগে সাধারণত সহজে ও দ্রুত পর্যটন ভিসা পাওয়া যেত — এমন কিছু দেশেও এক্ষেত্রে বেশি সময় লাগছে । বাংলাদেশিদের ভিসা পাওয়া ও নবায়নের ক্ষেত্রে জটিলতা সামনের দিনগুলোয় আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে । ভিসার আবেদন নাকচ হওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণভাবে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার ও দূতাবাসের কড়াকড়ির কথা বলা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তব কারণ ভিন্ন । অধিকাংশ দেশের ভিসা না পাওয়া এবং ভিসা নবায়ন না হওয়ার জন্য আবেদনকারীরা নিজেরাই দায়ী । এর মধ্যে বাংলাদেশিদের অন্যতম শীর্ষ গন্তব্য ভারত একটি বিশেষ ব্যতিক্রম ।
দেশটি গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর গুরুতর অসুস্থ রোগী ছাড়া অন্যদের ভিসার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে । কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তা এখনো বহাল আছে । ঢাকায় বিদেশি কয়েকটি দূতাবাস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা , বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাস ও বেসরকারি পর্যায়ের কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী , বাংলাদেশের হাজার হাজার নাগরিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট দেশে অবৈধভাবে থেকে যাওয়ার প্রবণতা সাধারণভাবে অন্যদের ভিসা পাওয়ার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় । এ ছাড়া জাল কাগজপত্র জমা দেওয়া , গুরুত্বপূর্ণ তথ্য না দেওয়া এবং মারাত্মক ভুল তথ্য দেওয়ার কারণে ভিসা আবেদন নাকচ হয় । এর বাইরে দূতাবাসে ভিসা কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্য জবাব দিতে না পারা , অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে না জড়ানো এবং ভিসার মেয়াদ শেষে ফিরে আসার নিশ্চয়তা না দিতে পারার কারণেও ভিসা আবেদন নাকচ হচ্ছে ।
কর্মকর্তারা বলছেন , নেতিবাচক এই দিকগুলো আগেও ছিল , তবে এখন অনেক বেড়ে গেছে । বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভিএফএস গ্লোবাল ১৬৫ টি দেশে তাদের ৩ হাজার ৯৩৬ টি অফিসের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের ভিসার আবেদন গ্রহণের কাজ করে থাকে । প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে ২০ টি এবং ভারতে ৮০ টি দূতাবাসের হয়ে ভিসাপ্রার্থীদের সেবা বাংলাদেশিদের ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধার বিষয় নিয়ে আজকের পত্রিকার সঙ্গে গত বুধবার ভিএফএস গ্লোবালের বাংলাদেশ ও ভারতীয় কার্যক্রমের দেয় ।
প্রধান সান্ত্বনা ভট্টাচার্যের কথা হয় । সান্ত্বনা ভট্টাচার্য জানান , দূতাবাসগুলো আবেদন বিবেচনার পর খামে ভরে পাসপোর্ট ফেরত দেয় বলে ঠিক কত ভিসার আবেদন নাকচ হয় , তা বলা কঠিন । তবে তাঁর অনুমান , বিভিন্ন কারণে অন্তত ৬০ ভাগ আবেদন নাকচ হয় । ভিএফএস ২০২৪ সালে বাংলাদেশে বিভিন্ন দূতাবাসের হয়ে প্রায় ১২ লাখ ভিসার আবেদন প্রসেস করেছে বলে জানান সান্ত্বনা । ভিএফএসের স্থানীয় প্রধান বলেন , করোনা সংক্রমণের সময় ভিসা ইস্যু কমে যাওয়ার পর মাঝখানে কিছুটা বেড়েছিল । এখন বিভিন্ন কারণে ভিসা পাওয়া আবার কমছে ।
কী কী কারণে ভিসার আবেদন নাকচ হয় , এমন প্রশ্নে সান্ত্বনা ভট্টাচার্য বলেন , ভিসাপ্রার্থীদের একটি বড় অংশ আবেদনের প্রক্রিয়া নিজে সম্পন্ন করেন না । অর্থের বিনিময়ে আবেদন করতে গিয়ে বিভিন্ন পেশাদার এজেন্টের সহায়তা নেন । অসাধু এজেন্টরা টাকা নিয়ে ভিসাপ্রার্থীদের জানিয়ে বা না জানিয়ে আবেদনপত্র নিজেদের ইচ্ছেমতো পূরণ করেন । নিজেরাই কাগজপত্র তৈরি করে দেন । দূতাবাসগুলো যাচাই করে অনেক আবেদনকারীর কাগজপত্র জাল ও তথ্যে ভুল দেখতে পায় । ইংরেজি - প্রধান দেশে কাজ করতে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে , এমন অনেক ভিসাপ্রার্থী সাক্ষাৎকারে সাধারণ ইংরেজিতেও কথা বলতে পারেন না । এমনকি , কিছু আবেদনকারী দোভাষীর কাছে বাংলাতেও নিজের তথ্য জানাতে বা প্রশ্নের জবাব ঠিকমতো দিতে পারে না ।
ভিএফএস প্রধান আরও জানান , বিদেশে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে অনেক নারী লম্বা সময়ের জন্য ‘ ফ্যামিলি ভিসা ' চান । কিন্তু সাক্ষাৎকারে ভিসা অফিসার জানতে চাইলে অনেক আবেদনকারী স্বামীর নামও বলতে পারেন না । এতে ভিসা অফিসারের সন্দেহ হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে হয়তো বৈধভাবে অবস্থানরত কাউকে স্বামী হিসেবে দেখিয়ে ভিসা চাওয়া হয়েছে । এর পেছনে মানব পাচারের সম্ভাবনা থাকতে পারে । ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে এই নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে যে শুধু ঢাকায় কথা হচ্ছে , তা নয় ।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বিদেশ সফরের সময় অনেক দেশ এ বিষয়গুলো তুলেছে । গত ফেব্রুয়ারিতে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরের সময় প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেশটির একজন মন্ত্রী ভিসার আবেদনপত্রের সঙ্গে ব্যাপকভাবে জাল কাগজপত্র পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন । আরব আমিরাত বহুদিন বন্ধ রাখার পর গত ৮ মার্চ আবার বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া শুরু করে । কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে গত ১০ মে থেকে আবার ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে ।
গত জুনে আমিরাত সরকারের একজন কর্মকর্তা মেজর জেনারেল সুহাইল সায়িদ আল খালিল ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধার দিকগুলো আবার তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ সহকারী লুৎফে সিদ্দিকীর কাছে । লুৎফে সিদ্দিকী গত ১৭ জুন এক পোস্টে বলেন , আমিরাতে ভিসা ও অবস্থানের নিয়মকানুন ভাঙার ২৫ শতাংশের বেশি ঘটনা ঘটিয়ে থাকে বাংলাদেশিরা । অথচ সরকারি হিসাবে আমিরাতে কাজসহ বিভিন্ন কারণে থাকা বিদেশিদের মাত্র আট শতাংশ বাংলাদেশের নাগরিক ।
একজন কূটনীতিক বলেন , শিক্ষাগত , বৈবাহিক ও অন্যান্য কাগজপত্র সত্যায়নের বিষয়গুলো অনলাইনে যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ এপোস্টিল কনভেনশনে যুক্ত হয়েছে । পরীক্ষামূলকভাবে চালুর মাস তিনেকের মধ্যেই এপোস্টিলের নকল বারকোডসহ কাগজপত্র আমিরাতে ধরা পড়েছে । আমিরাত শুধু নারী কর্মীদের ভিসা দেওয়া চালু রাখার সময় নারীর নাম দিয়ে পুরুষ প্রার্থীর ভিসা চাওয়ার ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে । বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দেশের মিশনগুলো ভিসার আবেদন যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি বাড়িয়েছে । সরকারি সফরের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি থাকলে আগে তুলনামূলকভাবে সহজে ভিসা পাওয়া যেত । এখন এমন চিঠি থাকার পরও সম্প্রতি উচ্চপদস্থ কয়েক কর্মকর্তার ভিসার আবেদন নাকচ হয়েছে ।
মার্কিন দূতাবাস সম্প্রতি একাধিক ফেসবুক পোস্টে বলেছে , প্রত্যেকের ভিসা আবেদন খুঁটিয়ে দেখা হয় । আবেদনকারীকে বিস্তৃত নিরাপত্তা যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় । এর মধ্যে রয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও সন্ত্রাসবিরোধী ডেটাবেইসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার কাজ । আবেদনকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী ধরনের পোস্ট দেন তা - ও খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে । জার্মানি যেতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ভিসার সাক্ষাৎকারের জন্য সময় পেতেই এখন দেড় থেকে দুই বছর লেগে যাচ্ছে । ভিসার ক্ষেত্রে ব্যাপক কড়াকড়ির সুযোগ নিতে তৎপর রয়েছে দালালচক্র । এই চক্রের অনেকেই সহজে ভিসার মিথ্যা নিশ্চয়তা দিয়ে ফেসবুকসহ বিভিন্ন উপায়ে প্রচারণা চালায় । বহু ভিসাপ্রার্থী তাদের ফাঁদে পা দেন । ভিসা আবেদনপত্র তৈরির ক্ষেত্রে অন্যের ওপর নির্ভরতা এড়িয়ে চলার তাগিদ দিয়ে ভারত , সুইডেন ও ডেনমার্কসহ বিভিন্ন দূতাবাস বলছে , আবেদনের সঙ্গে দেওয়া কাগজপত্রের পুরো দায়দায়িত্ব আবেদনকারীর । নিরাপদ থাকতে হলে আবেদনপত্রের ওপর ভিসাপ্রার্থীর নিজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার ।
অতি সম্প্রতি উগ্রপন্থা জঙ্গিসংশ্লিষ্টতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মালয়েশিয়ায় ৩৫ বাংলাদেশি আটক হওয়ার ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়েছে । দেশের একজন কূটনীতিক বলেছেন , ঘটনাস্থল মালয়েশিয়ায় হলেও অন্য দেশগুলোও বিষয়টির ওপর নজর রাখছে । জঙ্গিবাদসংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রমাণিত হলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশের ভিসা পাওয়া আরও কঠিন হতে পারে । নাগরিকদের বিদেশের ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে ভোগান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো . তৌহিদ হোসেন বলেছেন , ভিসা দেওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দেশের সার্বভৌম এখতিয়ার । এ ক্ষেত্রে সরকারের তেমন কিছু করার নেই । তারপরও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দূতাবাসগুলোকে নিয়মিত তাগিদ দেওয়া হয়ে থাকে ।
ভিএফএস গ্লোবাল কর্মকর্তা সান্ত্বনা ভট্টাচার্য মনে করেন , ভিসা পাওয়ার ভোগান্তি এড়াতে লোকজনের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি । ভারতে প্রবাসী ভারতীয় কল্যাণ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমন সচেতনতা তৈরিতে কাজ করে , এমনটা জানিয়ে তিনি বলেন , বাংলাদেশ সরকারেরও উচিত সচেতনতা তৈরির জন্য জোরালো কর্মসূচি নেওয়া ।