Image description
মোবাইল ফোনে প্রতারণা পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পরিচয়ে প্রতারণা তিন হাজার অভিযোগ তদন্তাধীন

মোবাইল ফোন ব্যবহার করে রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। নতুন কৌশলে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের বোকা বানিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসহ মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। ঊর্ধ্বতন পুলিশ ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে মামলার হুমকি কিংবা মামলা থেকে বাঁচানোর কথা বলে এই অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি। বিশ্বাসযোগ্য করতে প্রতারকচক্র পুলিশের ইউনিফর্ম পরা ছবিও ব্যবহার করছে।

প্রতারণার এই ফাঁদ এতটা বিস্তার লাভ করেছে যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পক্ষে এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। বর্তমানে শুধু ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার শাখায় এ ধরনের তিন হাজার অভিযোগ তদন্তাধীন। এ ছাড়া সিআইডিও বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।

সূত্র জানায়, ‘কল ফরওয়ার্ডিং’ কৌশল কাজে লাগিয়ে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের অজান্তে তাদের ফোন কল অন্য নম্বরে স্থানান্তর করে প্রতারকরা সাইবার প্রতারণা করছে।

এই প্রতারণা করতে চক্রটি একটি গ্রুপও তৈরি করেছে। চক্রের সদস্যরা শুরুতে ব্যক্তির মোবাইল ফোন চুরি করে। পরে ওই ফোন ব্যবহার করে তারা শুরু করে প্রতারণার কাজ। আরেকটি গ্রুপ বিভিন্ন এলাকার বিকাশের দোকানের নম্বর ব্যবহার করে প্রতারণার টাকা ক্যাশ করে।

পুলিশের সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো কোনো প্রতারক কৌশলে টার্গেট করা ব্যক্তির স্মার্টফোনে থাকা কল ফরওয়ার্ডিং সেটিংস পরিবর্তন করে দেয়।  এরপর সেই নম্বর ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের তথ্য পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যবহারযোগ্য পাসওয়ার্ড (ওটিপি) নিজেদের নম্বরে সরিয়ে নেয়। এভাবে মোবাইল ব্যাংকিং থেকে টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়। প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তি শুরুতে বুঝতে পারেন না তিনি প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। যখন বুঝতে পারেন, তখন সব শেষ।

একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, কিছুদিন ধরে সাইবার প্রতারকরা কখনো ‘আমি ডিবি বলছি’ বা ‘আমি অমুক থানার ওসি’ বলছি পরিচয় দিয়ে ফোন করে, আবার কখনো ফেসবুক মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ বা ইমো ব্যবহার করে পুলিশের নাম, ছবি ও পদবি ব্যবহার করে ভুয়া বার্তা পাঠায়। অনেক সাধারণ মানুষ এসব বার্তা বা কল পেয়ে বিশ্বাস করে ভয়ে অর্থ দিয়ে দেয়।

প্রতারকচক্রটি শুরুতে ফোন করে জানায়, ‘আপনার নামে মামলা হয়েছে’, ‘বিষয়টি মীমাংসা করতে হলে এখনই বিকাশে টাকা পাঠান।’ আবার কখনো কখনো বিভিন্ন পুলিশ কর্মকর্তার ইউনিফর্ম পরা ছবি ব্যবহার করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টার্গেট করা ব্যক্তিকে লেখে, ‘এই নম্বরে জরুরি যোগাযোগ করুন।’ এসব ভুয়া বার্তায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে নিজেকে রক্ষায় অর্থ পাঠিয়ে দিচ্ছে।

আবার কোনো কোনো চক্র টার্গেট ব্যক্তির খোঁজ-খবর নিয়ে তাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। তেমন এক সাইবার প্রতারক সাইফুল ইসলাম ওরফে দুর্জয়। সম্প্রতি তাঁকে রাজধানীর সবুজবাগ থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।

ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে দুর্জয় জানান, নিজের কাছে থাকা বিভিন্ন নম্বর থেকে অপরিচিত কোনো নম্বরে কল করতেন তিনি। অন্য প্রান্তে কল রিসিভ করলে প্রথমেই তিনি বলতেন, ‘দোস্ত কেমন আছিস, কই তুই? কিন্তু অন্য পাশ থেকে বুঝে ওঠার আগেই আবার বলতেন, ‘আমাকে চিনলি না! তোর স্কুল বন্ধু, বলতো আমি কে? কোন কোন স্কুল ফ্রেন্ডের সঙ্গে তোর যোগাযোগ হয়?’ কিংবা বলতেন, ‘চিনলি না? তোর কোন বন্ধুটি বিদেশ থাকে?’ এ ধরনের ইমোশনাল কথা বলে ধাঁধায় ফেলে প্রতারণা করতেন দুর্জয়।

ডিবি জানায়, ভুক্তভোগী আমির হোসাইন মোল্লাসহ তাঁর দুই বন্ধুর কাছে দুর্জয় নিজেকে ওদের বন্ধু আতিকুল্লাহ শাহ পরিচয় দিয়ে ফোন করেন। প্রতারক দুর্জয় মায়ের মৃত্যুর সংবাদের কথা জানিয়ে বিকাশে কিছু টাকা পাঠাতে অনুরোধ করেন তাঁদের। বন্ধু আতিকুল্লার মায়ের মৃত্যুসংবাদ শুনে তিন বন্ধু মিলে এক লাখ ৬৯ হাজার টাকা বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন। পরে তাঁরা বন্ধু আতিকুল্লাহ ভেবে প্রতারক দুর্জয়ের নম্বরে ফোন করলে আর তা খোলা পাওয়া যায়নি। এরপর তাঁরা বুঝতে পারেন, তাঁরা তিনজন প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন।

এরপর একজন ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ করেন। সেই সূত্র ধরে অভিযান চালিয়ে দুর্জয়কে গ্রেপ্তার করা হয়। দুর্জয় স্বীকার করেছেন, এভাবে প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি প্রতারণা করে আসছিলেন। তাঁর কয়েকজন সহযোগীও রয়েছে। যাদের কেউ কেউ মোবাইল ফোন চুরির দায়িত্ব পালন করে।

দুর্জয়কে গ্রেপ্তারের পর ডিবি জানতে পারে, গ্রেপ্তারের আগের ছয় মাসে তিনি শতাধিক সিম কার্ড ব্যবহার করে দুই হাজারের বেশি মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। যারা সহানুভূতি দেখিয়ে তাঁকে বিকাশ বা নগদের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে প্রতারিত হয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার শাখার প্রধান যুগ্ম পুলিশ কমিশনার সৈয়দ হারুন অর রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যারা প্রতারণা করছে তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এরই মধ্যে আমরা দুটি গ্রুপের সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছি। অন্যদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।’

তিনি বলেন, ‘সাইবার অপরাধ থেকে বাঁচতে সচেতনতা জরুরি। যে কেউ ফোন করে কোনো ধরনের তথ্য চাইলে তা দেওয়া ঠিক নয়। বর্তমানে পুলিশ ও  প্রশাসনের নানা পদবির কর্মকর্তাদের পরিচয় দিয়ে তথ্য সংগ্রহে প্রতারণা করা হচ্ছে। প্রতারকরা ফোন করে বলে, আপনি কোনো একটি অপরাধী গ্রুপে যুক্ত হয়েছেন। সেখান থেকে বাঁচতে হলে ওটিপি নম্বর দেন। নম্বর দিলেই শুরু হয় প্রতারণা।’

তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমানে তিন হাজার অভিযোগ রয়েছে আমাদের হাতে। আমরা সবগুলো তদন্ত করছি। থানাগুলোতে জিডি বা মামলা করার পর সেই অভিযোগগুলো আমাদের কাছে আসে। এই প্রতারণা থেকে বাঁচার একটাই উপায়, কেউ ফোন করে তথ্য চাইলে কোনো ধরনের তথ্য দেওয়া যাবে না।’