Image description
নির্বাচন কমিশনের আরপিও সংশোধনীর খসড়া

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘না ভোট’ চালুসহ বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ লক্ষ্যে নির্বাচনের প্রধান আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ, ১৯৭২ (আরপিও)’-এ কমবেশি অর্ধশত সংশোধনী এনে একটি খসড়া তৈরি করেছে। এতে যেসব আসনে একক প্রার্থী থাকবেন, সেখানে ‘না ভোট’ চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। ওই সংশোধনী পাশ হলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ-সদস্য হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, প্রার্থীর চেয়ে ‘না ভোট’ বেশি পড়লে সেই আসনে আবারও ভোট হবে। ইসির কর্মকর্তারা মনে করছেন, এ বিধান যুক্ত হলে রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। পাশাপাশি অন্য রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতা কমবে। যদিও এ সংশোধনী রাজনৈতিক দলের মতামতের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে। দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতেই বিষয়টি চূড়ান্ত করতে চায় ইসি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

ইসি সূত্রে আরও জানা যায়, খসড়ায় সংসদ-সদস্য প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতায় সংশোধনী আনা হয়েছে। এতে সংসদ-সদস্য প্রার্থী হওয়ার জন্য সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা ‘স্নাতক পাশ’ হতে হবে। একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ দুটির বেশি আসনে প্রার্থী হতে পারবেন না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীন কোনো অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হলে তিনি প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন।

জানতে চাইলে ইসির আইন সংস্কার কমিটির প্রধান নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনে ‘না ভোট’ চালু করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের প্রয়োজন হবে। আমরা রাজনৈতিক ঐকমত্যের দিকে তাকিয়ে আছি। রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করব। আরপিও সংশোধনের বিষয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ ত্বরান্বিত করতে কমিশন সভায় একটি খসড়া সংশোধনী দেওয়া হয়েছে। এটি আরও সংযোজন-বিয়োজন হবে। প্রবাসীদের ভোটাধিকারের সুযোগ দিতে আরপিওতে সংশোধনী আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে প্রবাসীদের সহজ ও কার্যকর পদ্ধতিতে কীভাবে ভোটাধিকারের সুযোগ দেওয়া যায়, সেই বিষয়েও কাজ চলছে।

নির্বাচনে ‘না ভোট’ পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়ার প্রয়োজন দেখছেন না জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ‘না ভোট’ চালুর সুপারিশ করেছে। এটির জন্য সংবিধান সংশোধনেরও প্রয়োজন নেই। কমিশন চাইলে আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে এটি কার্যকর করতে পারে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ‘না ভোট’ ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে ওই নিয়ম জাতীয় সংসদে পাশ করেনি। এর ফলে ২০১৪ সালে ১৫৩টি আসনে বিনা ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পেরেছিল। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরও আমরা কেন আওয়ামী লীগের চেনা পথে হাঁটব?

নির্বাচন ভবনে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত কমিশনের অষ্টম সভায় ওই খসড়া সংশোধনী উপস্থাপন করা হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন। সময়স্বল্পতার কারণে ওই সভায় আরপিও সংশোধনী বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। শিগ্গিরই কমিশনের আরেকটি সভায় এ খসড়ার ওপর আলোচনা হবে বলে শুক্রবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। তিনি বলেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের বিষয়টি সভায় উপস্থাপন হয়েছে। পরে এটি নিয়ে আলোচনা হবে।

বৈঠক সূত্রে আরও জানা যায়, আরপিওর খসড়া সংশোধনীতে নির্বাচন পরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ইসির ক্ষমতা বাড়াতে বেশকিছু প্রস্তাব আনা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নির্বাচনি সহায়তার বিষয়ে সরকার ও ইসির মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে নির্বাচন কমিশনের চাহিদা প্রাধান্য দিতে হবে। এমনকি সরকারের কোনো বিভাগ ও কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্তব্যে অবহেলা করলে তাদের বিরুদ্ধে ইসির শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক হবে এবং তা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর ব্যক্তিগত নথি, চাকুরির বহি ও বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনে উল্লেখ থাকবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় যুক্ত হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি)।

এছাড়া নির্বাচনে প্রার্থীদের ব্যয় মনিটরিং, প্রার্থীদের হলফনামায় বিদেশে থাকা সম্পদের তথ্য দেওয়া, হলফনামায় অসত্য তথ্য দিয়ে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তা বাতিলের বিধান, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বাড়ানো, একই আসনে সমানসংখ্যক ভোট পেলে সেখানে পুনরায় ভোটগ্রহণ, ভোটকেন্দ্রের ভেতরে অহেতুক ঘোরাঘুরি করলে গ্রেফতার, রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও ওয়েবসাইটে প্রকাশ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন স্থগিত রাখাসহ বেশি কিছু নতুন বিধান যুক্তের প্রস্তাব করা হয়েছে।

না ভোট : সূত্র জানায়, খসড়া আরপিওর অনুচ্ছেদ-১৯-এ সংশোধনী এনে ‘না ভোট’ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রার্থী বাছাইয়ের পর কোনো নির্বাচনি এলাকায় একজন বৈধ প্রার্থী থাকলে সেক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং ‘না ভোট’-এর মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর তুলনায় ‘না ভোটের’ সংখ্যা সেখানে পুনরায় তফশিল ঘোষণা করে ভোট হবে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ভোটের সংখ্যা বেশি হলে তিনি জয়ী হবেন।

প্রয়াত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন ‘না ভোট’ চালু করেছিল। তখন ৩০০ আসনের ব্যালটে ‘না ভোট’ ছিল। ওই নির্বাচনে দশমিক ৫৫ শতাংশ না ভোট পড়েছিল, যদিও তা কোনো আসনের ফলকে প্রভাবিত করেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংসদে ‘না ভোট’ পাশ করেনি।

ইসির ক্ষমতা বৃদ্ধি : জানা যায়, খসড়া আরপিওর কয়েকটি অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনে নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং কর্মকর্তার ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অনুচ্ছেদগুলো হচ্ছে-৫, ৭, ১৫, ২৯, ৪৪, ৮৯ ও ৯১। অনুচ্ছেদ-৫(৩)-এ নির্বাচন কমিশনকে সহায়তার ক্ষেত্রে সরকার ও ইসির মধ্যে মতবিরোধ দেখা নির্বাচন কমিশনের চাহিদাকে প্রাধান্য দেওয়ার বিধান যুক্তের প্রস্তাব করা হয়েছে। আর ৫(৪)-এ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সরকারের কোনো বিভাগ কর্তব্যে অবহেলা করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ইসিকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ-১৫-এ নির্বাচনে প্রার্থীদের আপিল নিষ্পত্তির পর কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচনার নতুন প্রস্তাব যুক্তের কথা বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, ইসিকে নোটিশ ও শুনানি ছাড়া আদালত কোনো আদেশ বা নির্দেশ দেবেন না। অনুচ্ছেদ-২৯-এ ভোটকেন্দ্রের চৌহদ্দির মধ্যে অনুমোদন নেই-এমন ব্যক্তি ঘোরাফেরা করলে তাদের গ্রেফতারের বিধান যুক্তের প্রস্তাব করা হয়েছে।

অনুচ্ছেদ-৪৪-এ নির্বাচনে প্রার্থীদের ব্যয় মনিটরিং, প্রার্থীদের ব্যয় অডিট করা এবং রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয় অডিট করার ক্ষমতা ইসিকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এমনকি নির্বাচনে জয়ের পরও আর্থিক অনিয়ম প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংসদ-সদস্য পদ বাতিল করতে পারবে ইসি। এ অনুচ্ছেদে উপধারা যুক্তের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে নির্বাচনে কেউ অসত্য তথ্য দিয়ে অভিযোগ করার পর তা প্রমাণিত হলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে ইসি।

৮৯ অনুচ্ছেদে নির্বাচনি অপরাধ এবং আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে ইসিকে আরও ক্ষমতায়িত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ৯১ অনুচ্ছেদে ভোটে অনিয়ম হলে পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

অন্যান্য : জানা যায়, সংশোধনীতে একজন প্রার্থী দুটি আসনে লড়তে পারবেন। বর্তমানে একজন একই সঙ্গে তিন আসনে প্রার্থী হতে পারেন। এজন্য ১৩(ক) অনুচ্ছেদে সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ-২০-এ একই মঞ্চে সব দলের প্রার্থীদের নিয়ে অনুষ্ঠান করার ক্ষমতা রিটার্নিং অফিসারকে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। ওই মঞ্চে সব প্রার্থী নির্বাচনি ইশতেহার ও আচরণ বিধিমালা প্রতিপালনের অঙ্গীকার করতে পারবেন। তবে তারা ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বক্তব্য দিতে পারবেন না। অনুচ্ছেদ-২৭-এ প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেওয়ার সুযোগ দিয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে।