Image description

জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় পতিত আওয়ামী লীগ সরকারকে রক্ষায় শত শত নিরস্ত্র সাধারণ জনতার খুনের মাস্টারমাইন্ডরা এখনো অধরা। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাদের বাইরে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আনসারসহ বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত গুলির নির্দেশদাতা কর্মকর্তারাও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদের মধ্যে অনেকেই অদৃশ্য শক্তির বলে দেশে থেকে পালিয়ে গেলেও কেউ কেউ মোটা অঙ্কের টাকা ও তদবিরের জোরে নিজ বাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

আওয়ামী সরকারকে রক্ষায় নির্বিচারে গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হাজার হাজার সাধারণ যুবক-কিশোর আহত হয়ে রাজধানীসহ দেশে বড় বড় শহরগুলোতে এখনো চিকিৎসাধীন। এদের মধ্যে অনেকেই হাত-পা ও চোখ হারিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন। অথচ এসব নিষ্ঠুর হত্যাকা- এবং নির্যাতনের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় জড়িতদের গ্রেফতারের কোনো উদ্যোগ নেই পুলিশ প্রশাসনে। আন্দোলনে গুলি করে লাশ ফেলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছেন শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা। তাদের অনেকেই এখনো পুলিশ সদর দফতর, এসবি, স্টাফ কলেজ, সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইউনিটের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে পলাতক পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে মধ্য জুলাই থেকে শুরু করে ৫ আগস্ট পর্যন্ত নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। বিশেষ করে ঢাকা শহর, গাজীপুর মেট্টোপলিটন এলাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয় শত শত ছাত্র-জনতা। আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকে সাবেক মন্ত্রী-এমপি, নেতাকর্মী, পুলিশ, বিচারক ও আমলাদের বিরুদ্ধে শুরু হয় মামলা। এর মধ্যে এএসপি থেকে সাবেক আইজিপি পর্যায়ের ২৫০ জন পুলিশ কর্মকর্তা এবং পুলিশ ইন্সপেক্টর থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত ৭০০ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়। অভিযোগ রয়েছে, আন্দোলনে গুলি করে লাশ ফেলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছেন শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা। এর মধ্যে মাত্র ১০ জন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সরকারের প্রথম উদ্যোগ হওয়া উচিত যারা জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় নিরিহ ছাত্র-জনতাকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যার নির্দেশদাতা এবং সরাসরি হত্যার সাথে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করা। সারা দেশে দায়েরকৃত হত্যা মামলায় যে সব দুর্বলতা রয়েছেন তা দূর করতে বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ সেল তৈরি করা। পুলিশ সদর দফর থেকে ওই সেলের মাধ্যমে সারা দেশের মামলাগুলো মনিটরিং করে দ্রুত চার্জশিট দাখিলের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও স্থানীয়দের কাছ থেকে ভিডিও, স্টিল ছবিসহ সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা। যা মামলার আলামত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, পুলিশ সদর দফতরের পিআইএমএসয়ে বসেই সারা দেশের মামলাগুলো তদারকি করা সম্ভব। একই সাথে তদন্তের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের অল্প সময়ের প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও অনেক ক্ষেত্রে তদন্তের সুষ্ঠু গাইডলাইন দিয়ে মামলার তদন্ত গতিশীল করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন। হত্যা মামলায় নিরীহ অনেক মানুষকে ব্যক্তিগত শত্রুতা, এলাকাভিত্তিক দ্বন্দ্ব বা রাজনীতির হয়রানি করা না হয় সে বিষয়েও মনিটরিং করতে পারবেন তদারকি কর্মকর্তারা। অনেক হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে হাজার হাজার ব্যক্তিকে। এ ছাড়া কোনো কোনো মামলায় অজ্ঞাত হিসেবে আরো কয়েক শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। সঠিক তদারকির মাধ্যমে এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তারা ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে অপরাধ বিষেজ্ঞরা মনে করেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট বিকেলেও রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় বেপরোয়া পুলিশ নির্বিচারে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। আন্দোলন দমাতে শেখ হাসিনা সরকার দফায় দফায় ইন্টারনেট বন্ধ করে, যাতে ওই সময়ে পুলিশ সদস্যদের বেপরোয়া তা-ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ না পায়। পর্যায়ক্রমে সেসব নৃশংস হত্যাকা-ের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে শুরু করেছে। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দায়ের করা কিছু মামলার এজাহার এবং ওই সময়ের ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশের তা-বের বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে।

যা নিয়ে খোদ পুলিশ বাহিনীতেই রয়েছে চরম অসন্তুষ। ছাত্র-জনতার কঠোর আন্দোলনকালে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারকে রক্ষায় মাস্টারমাইন্ড কর্মকর্তাদের অন্যতম এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিএমপি সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, পুলিশ সদর দফতরের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়াদ্দার, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, ডিএমপি ডিবির সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার নুরু নবী ও সঞ্জয় কুমার, সাবেক সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, সাবেক সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান, সিটিটিসির সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার কামরুজ্জামান, সাবেক ডিআইজি রিপন সরদার, সাবেক ডিআইজি খালিদ হাওলাদার, ডিএমপি সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান, সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান. সাবেক যুগ্ম পুলিশ কমিশনার সঞ্জিত কুমার রায়, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি মারুফ হোসেন সরদার, রমনা বিভাগের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ আশরাফ ইমাম, ডিএমপির সাবেক ডিসি তানভির সালেহীন ইমন, গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের সাবেক ডিসি মশিউর রহমান, সাবেক ডিসি মাহফুজুল আল রাসেল, সিটিটিসির সাবেক ডিসি জাহিদ তালুকদার, উত্তরার সাবেক ডিসি আশরাফুল আজিম, তেজগাঁও বিভাগের সাবেক ডিসি এইচ এম আজিমুল হক ও হাফিজ আল ফারুক, সবুজবাগ জোনের সাবেক এডিসি গোবিন্দ চন্দ্র, ডিবির সাবেক এডিসি জুয়েল রানা, হাসান আরাফাত, নাজমুল ইসলাম, মতিঝিল বিভাগের সাবেক এডিসি সাব্বির রহমান, ডিবির সাবেক এডিসি ফজলে এলাহী, মোহাম্মদপুর জোনের সাবেক এডিসি মো. রওশানুল হক সৈকত, ডিবির সাবেক এডিসি শফিকুল ইসলঅম, রফিকুল ইসলাম, আক্তার মকুল, ডিবি সাইবার ক্রাইম ইউনিটের এডিসি ফজলুর রহমান ও নিশাত রহমান মিতুল ও ওয়ারী বিভাগের সাবেক এডিসি শাকিল মোহাম্মদ শামীম।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, জুলাই বিপ্লবের সময় পুলিশ সদর দফতরের এলআইসির প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তিনি মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে জড়ো হওয়া সব ছাত্রকে খুঁজে বের করেছিলেন। তিনি ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে সমস্ত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। এরপর তিনি পুলিশকে সেসব স্থানে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং নিরীহ মানুষ ও ছাত্রদের গুলি করা হয়। তিনি এখনো হাইওয়ে পুলিশ সদর দফতরে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে আছেন। আরেক পুলিশ কর্মকর্তা ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় এলআইসির প্রধান ছিলেন এবং সারা দেশের সব এসপির কাছে সমস্ত গোয়েন্দা তথ্য দিয়েছিলেন। তিনি সেই সময় জেলা এসপিদের মধ্যে অর্থ বিতরণ করেছিলেন। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে, তিনি গণহত্যার জন্য পুলিশকে নির্দেশনা দেয়ার জন্য হাসিনার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমস্ত সমন্বয় সাধন করেছিলেন। তিনি এখন সিআইডিতে কর্মরত। তার পরও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাদের পুরস্কৃত করছে।

পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় রুজুকৃত মামলার তদন্তে যাতে কোনো ধরনের গাফিলতি না হয় এ জন্য বিশেষ তদারকির ব্যবস্থা করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারীর কাছ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তদন্তের নিয়মিত আপডেট নিচ্ছেন। একই সঙ্গে তদন্তে যাতে কোনো ধরনের ফাঁকফোকর ও দুর্বলতা না থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য মামলার সুপারভিশন কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হয়েছে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হলেও নির্দোষ কোনো ব্যক্তি যাতে ফেঁসে না যায় সে ব্যাপারে তারা সতর্ক। পাশাপাশি এজাহারভুক্ত আসামি না হলেও হত্যাকা-ে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তি যেন পার পেয়ে না যায় সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের এআইজি মিডিয়া ইনামুল হক সাগর বলেন, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল তাদের অনেককেই আমরা ইতোমধ্যে আইনের আওতায় এনেছি। যেসব আসামিকে এখনো গ্রেফতার করা যায়নি, তাদের ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।